শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন




বিলিংয়ের ৯৮% আদায়ের দাবি ঢাকা ওয়াসার, গায়েব ৩২২১ কোটি টাকা

আউটলুকবাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ১১:৫৫ am
Managing Director WASA Taqsem A Khan ওয়াসা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি তাকসিম আহমেদ খান
file pic

গত নয় বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে ৯৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে-এমনটি দাবি করেছে ঢাকা ওয়াসা। সেই হিসাবে আদায়ের অঙ্ক দাঁড়ানোর কথা ১৬ হাজার ৩৪৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ১৩ হাজার ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যেটি মোট রাজস্ব আদায়ের ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার অডিট রিপোর্ট এবং বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাস্তবতার সঙ্গে হিসাবের এমন গরমিল পাওয়া গেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পানির দাম ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাইজেশন হওয়ায় রাজস্ব আদায় বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র উলটো। দিন যতই যাচ্ছে, রাজস্ব আদায় বাস্তবের তুলনায় কম হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের চুরি, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা ওয়াসার অডিট রিপোর্টের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ২৪২ কোটি টাকা, যা প্রাপ্যতার চেয়ে ২১ শতাংশ কম। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ২৪২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে, যা ২০ শতাংশ কম। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৩০৪ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ কম। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৩৩০ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ২০ দশমিক ২২ শতাংশ কম। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩০১ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪৮০ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ২৪ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫৮২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ২৫ শতাংশ কম। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪৩০ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে, যা ১৮ শতাংশ কম। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩১০ কোটি টাকা কম আদায় রয়েছে, যা ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ কম।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের বড় একটি অংশের রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। শুধু তাই নয়, সেবা আওতার পুরো অংশের বিলিংও করতে পারছে না। সেখানে তাদের ৯৮ শতাংশ বিল আদায় করার দাবি বড় মিথ্যাচার।

তিনি বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের পানি ব্যবহারের বাণিজ্যিক বিল দিতে হয়। কিন্তু সেখানে আবাসিক বিল দেওয়া হয়। এভাবেও অনেক অপচয় ঘটছে ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সেসব স্বীকার করছে না। সফলতা দেখাতে গিয়ে তারা বেশি বেশি বলছেন। তাহলে সেই টাকা গেল কোথায়?

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫০৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। তখন ঢাকা ওয়াসার বিলিং সিস্টেম ম্যানুয়াল ছিল। সেসময় ঢাকা ওয়াসা ৯৩ শতাংশ বিলিং করতে পারত। আর বিল আদায় করতে পারত ৬৪ শতাংশ। এরপর ধাপে ধাপে বিলিং সিস্টেম ডিজিটাইজেশন হয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ডিজিটাইজেশন কাজ শেষ হওয়ায় শতভাগ বিলিং শুরু হয়। এতে ৯৮ শতাংশ বিল আদায় হচ্ছে বলে দাবি করছে ঢাকা ওয়াসা। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর প্রকাশিত স্মরণিকায় এমন তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ওয়াসার ৩টি পানি শোধনাগার প্রকল্প উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এই স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। প্রকল্পগুলো হলো-পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প, তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা ওয়েল ফিল্ড প্ল্যান্ট এবং গন্ধবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প। আর ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের সংস্থার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান তার লিখিত বাণীতে বিলিং সিস্টেম শতভাগ ডিজিটাইজেশন হয়েছে বলে দাবি করেন।

ঢাকা ওয়াসার বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে পানির দাম আবাসিক ও বাণিজ্যিকে ১ দশমিক ২৮ গুণ বেড়েছে। এছাড়া গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। মোট গ্রাহকের ৯১ শতাংশ আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ৯ শতাংশ। এসব প্যারামিটার এবং অন্যান্য আয় অনুযায়ী এই অর্থবছরে ১ হাজার ১৫৩ কোটি ১০ লাখ টাকা আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু আদায় হয়েছে ৯১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা অর্থাৎ কম আদায় হয়েছে ২৪২ কোটি টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিক ও বাণিজ্যিকে পানির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩৪ গুণ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ২৬ গুণ। পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার অন্যান্য আয় মিলিয়ে এই অর্থবছরে আদায় হওয়ার কথা ১ হাজার ২১৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ৯৭১ কোটি ৩ লাখ টাকা অর্থাৎ কম আদায় হয়েছে ২৪২ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় পানির দাম আবাসিকে ১ দশমিক ৫৭ গুণ, বাণিজ্যিকে ১ দশমিক ৫৩ গুণ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩০ গুণ। পাশাপাশি অন্যান্য আয় মিলিয়ে আদায় হওয়ার কথা ১ হাজার ৪৫৯ কোটি ৪ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ১ হাজার ১৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা আয় হয়েছে, অর্থাৎ ৩০৪ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ১ দশমিক ৭৪, বাণিজ্যিকে ১ দশমিক ৬৭ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩০ গুণ। পাশাপাশি অন্যান্য আয়সহ আদায় হওয়ার কথা ১ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ হাজার ৩০২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, অর্থাৎ কম আদায় হয়েছে ৩৩০ কোটি টাকা।

২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ১ দশমিক ৮২, বাণিজ্যিকে ১ দশমিক ৭৫ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩২ গুণ। পাশাপাশি অন্যান্য আয় মিলিয়ে আদায় হওয়ার কথা ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩০১ কোটি ২২ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ২ দশমিক ২, বাণিজ্যিকে ১ দশমিক ৮৬ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩৭ গুণ। এছাড়া অন্যান্য আয় মিলিয়ে আদায় হওয়ার কথা ছিল ১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২০ লাখ টাকা, অর্থাৎ কম আদায় হয়েছে ৪৮০ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ২ দশমিক ৪, বাণিজ্যিকে ২ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩৭ গুণ। অন্যান্য আয় মিলিয়ে আদায় হওয়ার কথা ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ হাজার ৭৫৩ কোটি ২ লাখ টাকা, কম আদায় হয়েছে ৫৮২ কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ২ দশমিক ৫১, বাণিজ্যিকে ২.০৯ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩৩ গুণ। অন্যান্য আয় মিলিয়ে এই অর্থবছরে আদায় হওয়ার কথা ২ হাজার ৩৮৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, ৪৩০ কোটি টাকায় আদায় কম হয়েছে।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের তুলনায় আবাসিকে পানির দাম ২ দশমিক ৫১ গুণ, বাণিজ্যিকে ২.০৯ গুণ এবং গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ৩৫ গুণ। এছাড়া অন্যান্য আয় মিলিয়ে এই অর্থবছরে আদায় হওয়ার কথা ছিল ২ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। অথচ আদায় হয়েছে ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা, কম আদায় হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : অভিমত জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠালেও তাতে সাড়া দেননি। পরে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এএম মোস্তফা তারেকের সহায়তা চাইলে তিনি ঢাকা ওয়াসার এমডির সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি (এমডি) কোনো মতামত না জানিয়ে সংস্থার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী উত্তম কুমার রায়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপককে ফোনে কল করলে তিনি সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। মঙ্গলবার দুপুরে নির্ধারিত বিষয়ে মতামত জানতে কাওরান বাজারে ঢাকা ওয়াসা ভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়।

রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে অডিট প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তব হিসাবের গরমিল তুলে ধরলে তিনি জানান, গাণিতিক নিয়মে ফেলে হিসাব করলে এমন চিত্র আসতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল থাকে না। বাস্তবতা হলো-পানির দাম বাড়ার সঙ্গে গ্রাহকরা পানির খরচও কমিয়ে দেন। সেটা তো গাণিতিক হিসাবে ধরা পড়বে না। তাছাড়া ঢাকা ওয়াসার পানির বিলের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য পরিমাণ অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যেটা বন্ধে কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনাদের কাছে তথ্য আসামাত্রই জানাবেন। দেখবেন বিদ্যুৎ গতিতে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। ঢাকা ওয়াসা নিজ গরজে এসব অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।(যুগান্তর)




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD