৯০’র দশক থেকে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগকে স্বীকৃতি জানানো হয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ সংসদে পাস হয়। এটি পরে ১৯৯৮ ও ২০১০ সালে সংশোধন করা হয়। ২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বৈষম্য কাটেনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ২০১০ এর খসড়া আইনের ৪২ ধারায় উল্লেখ আছে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন টিউশন ফি নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছেমত টিউশন ফি নির্ধারণ করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আইন থাকলেও তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষাকে সবসময় অলাভজনক খাত হিসেবে বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বা লাভজনক ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার একাধিকবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর ভ্যাট ও ট্যাক্স আরোপ করে। ২০১৫ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। পরবর্তীতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। যা বর্তমানে বহাল আছে। এখন প্রশ্ন আসে অলাভজনক খাত কর বা ভ্যাট আরোপ কি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি বাস্তবায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ঢাকার বাইরের একটি জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মান বিবেচনা টিউশন ফির তারতম্য আছে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে না। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও পড়াশুনা করে।’
তিনি বলেন, ‘আইনে উল্লেখ থাকলেও নানা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তা বাস্তবায়ন করা সময় সাপেক্ষ। তবে এই আইন কার্যকর হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি কেন্দ্রিক যে জটিলতা ও ভিন্নতা নিরসন করা সম্ভব হবে।’
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্টার ফরিদ হোসাইন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারিত হয় একাডেমিক মান ও শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের উপর। যে কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে টিউশন ফি তারতম্য রয়েছে। এ নিয়ে আইন থাকলেও ইউজিসি থেকে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অফিসে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কথা বলতে অপরগতা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক শোয়াইব আহম্মেদ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হলেও কার্যত তা হয়নি। এই আইনে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদন্ডে টিউশন নেওয়ার বিধান থাকলেও সেটা মানছে না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা দাবি দীর্ঘদীন ধরে দাবি করে আসছি দেশের আর্থ-সামাজিক এবং বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যেহেতু কৃষিজীবী পরিবার থেকে উঠে আসে সেই অবস্থার বিবেচনায় অভিন্ন টিউশন ফি চালুর কথা। বরং অন্তর্বতীকালীন সরকার সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকার ১০% ট্যাক্স আরোপ করেছে। হাসিনার আমলের ট্যাক্স ড. ইউনূসের আমলেও বহাল রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে অসামান্য অংশগ্রহণ ছিলো তার প্রেক্ষিতে আমরা আশা করেছিলাম সরকার বিগত স্বৈরাচারী আমলে আরোপিত ভ্যাট বাতিল করবে। ২০১৫ সালে পতিত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম যে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রভাব পরবর্তী প্রত্যেকটা আন্দোলনে উপস্থিত ছিলো। পাশাপাশি চাকুরিক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। কয়েকবার ইউজিসির তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো তা কার্যকর করা হয়নি।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মামুনবলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে। আইন থাকা স্বত্বেও তা বাস্তবায়ন না করা দুঃখজনক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় তার আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’
শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিক্ষার গুণগত মান সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে, শিক্ষা যেন সঠিকভাবে হয়। এর জন্য একটা সিলেবাস থাকবে। একটা সময়সীমা থাকবে। ইউনিটস থাকবে। ক্রেডিটস থাকবে। আউটলাইন থাকবে। এগুলো যেন পরিপূর্ণভাবে করা হয়। আমরা অনেক অভিযোগ শুনি, পর্যাপ্ত ক্লাস না নিয়েই কোর্স শেষ করে দেয়া হয়। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। আপনি যদি শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে চান তাহলে একজন গ্র্যাজুয়েটকে প্রফেশনাল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
তারা বলেন, আইন দ্বারা স্বীকৃত অলাভজনক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে উপর্যুপরি ভ্যাট, ট্যাক্স আদায়ের ঘটনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো প্রকার সরকারি সহয়তা ছাড়া কেবল টিউশন ফি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়মিত পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি ক্যাম্পাস নির্মাণ-বর্ধিতকরণ, ল্যাব-লাইব্রেরি সম্প্রসারণের মতো অত্যাবশ্যকীয় সব কাজ করতে হয়। আশা করি সমস্যাটির আশু সুরাহা হবে। রূপালী বাংলাদেশ