খেলাপি ঋণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অর্থঋণ আদালত আইনে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায় ঋণগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তি ছাড়াও নামে-বেনামে থাকা দেশি-বিদেশি সম্পদ বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কেউ আপিল করতে চাইলে অনাদায়ী ঋণের ৫০ শতাংশ আদালতে জমা দিতে হবে। আর কোনো রায় রিভিউয়ের আবেদন করলে জমা দিতে হবে ৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া কিছু দিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বিভিন্ন পক্ষের মতামতের জন্য আজ সোমবার এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় একটি সভা ডাকা হয়েছে বলে জানা গেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে অধ্যাদেশটি জারি হলে বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ বিলুপ্ত হবে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, মামলা নিষ্পত্তির আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা বা স্থিতি বজায় রাখার নির্দেশ দিতে পারবেন অর্থঋণ আদালত। আদালত ঋণখেলাপির জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট সাময়িকভাবে বন্ধ বা বাতিল করতে পারবেন। বন্ধকি সম্পত্তিতে রিসিভার নিয়োগ, ক্রোকাদেশ, অ্যাকাউন্ট বা সম্পদ স্থগিত রাখার আদেশ দিতে পারবেন। দেওয়ানি কারাগারে আটক আদেশসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ দিতে পারবেন।
অবশ্য বেশ আগ থেকে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছেন ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৫-এর বিচারক মুজাহিদুর রহমান। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় তাঁর দেওয়া একটি আদেশের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন ঋণখেলাপি এএফসি হেলথের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুয়েল খান। হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ১২ দফা নির্দেশনাসহ ঋণখেলাপিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ বহাল রেখে গত জানুয়ারিতে রায় দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, অর্থঋণ আদালতগুলোতে বর্তমানে ৮০ হাজারের মতো বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। মূলত মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এমনটি হয়েছে।
বিদ্যমান আইনের মতো প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায়ও বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতে মামলা করার পর ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। আদালত এই সময় আরও ৩০ দিন পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন। মামলাজট এড়াতে বিদ্যমান আদালত সংখ্যা ৭টি থেকে বাড়িয়ে প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
খসড়া বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতের আদেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এই আইনের বিধান ছাড়া কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন কোনো কার্যধারা বা কোনো আদেশ, রায় বা ডিক্রির বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এই আইনের বিধানকে উপেক্ষা করে কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে প্রতিকার দাবি বা প্রার্থনা করলে কোনো আদালত তা গ্রহণ করবে না। তবে মামলার কোনো পক্ষ কোনো অর্থঋণ আদালতের আদেশ বা ডিক্রির কারণে সংক্ষুব্ধ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে অর্থঋণ আপিল আদালতে আপিল করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আপিলকারী অনাদায়ী টাকার ৫০ শতাংশ সমপরিমাণ না দিলে আপিল গ্রহণ হবে না। আপিল গ্রহণের পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে আপিল আদালত মামলা নিষ্পত্তি করবেন। তাতে ব্যর্থ হলে আরও ১৫ দিন সময় বাড়ানো যাবে। সুপ্রিম কোর্টে আপিলের ক্ষেত্রেও সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে। এর বাইরে কোনো আদালত বা আপিলের বিরুদ্ধে রিভিশন দরখাস্ত দিতে চাইলে অনাদায়ী ঋণের ৭৫ শতাংশ সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার বা নগদায়নযোগ্য অন্য কোনো বিনিময়ে আদালতে জমা দিতে হবে। অবশ্য ব্যাংক আপিল করলে কোনো টাকা জমা দিতে হবে না। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কেউ যদি টাকা জমা না দিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল বা রিভিশন দায়ের করে নিম্ন আদালতের আদেশ বা ডিক্রিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিতর্কিত করেন। ওই রিট আবেদন হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগে খারিজ হয় তা নিষ্পত্তিতে উল্লিখিত সময়ের জন্য ৪০ শতাংশ হারে সুদ বা মুনাফা আরোপ হবে। আদালত অবমাননার দায়ে কোনো ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিতে পারবেন আদালত।
এতে বলা হয়েছে, বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ আদায় না হলে বাকি টাকা আদায়ের জন্য দায়ী ব্যক্তির অদায়বদ্ধকৃত যে কোনো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি যেমন– জমি, দালানকোঠা, যানবাহন, নগদ টাকা, ব্যাংক আমানত, বিনিয়োগ বা পাওনা ক্রোক বা বিক্রির আদেশ দিতে পারবেন। এমনকি ঋণের টাকায় বেনামে কেনা সম্পদ বিক্রি করেও ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা যাবে। ভবিষ্যতে পাবেন, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দায়ীকের সঙ্গে বা ঋণের টাকার সঙ্গে সম্পর্কিত সম্পদের ওপরও আদালত ডিক্রি দিতে পারবেন। এমনকি দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দিয়েও ঋণ সমন্বয়ের নির্দেশ দিতে পারবেন আদালত।
এতে আরও বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতাকে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিতে পারবে ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিন সময় দিয়ে তাঁকে নোটিশ দিতে হবে। সম্পত্তি বিক্রি করা টাকা মোট ঋণের চেয়ে বেশি হলে অতিরিক্ত অর্থ ঋণগ্রহীতা রেখে দিতে পারবেন। এ ছাড়া বর্তমানের মতো নিলাম প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে অর্থ আদায় করতে পারবে ব্যাংক। সমকাল