প্রচলিত রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য সাধারণত ক্ষমতা অর্জন। ক্ষমতার এই প্রতিযোগিতামূলক অঙ্গনে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য বহু ক্ষেত্রে এমন সব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যা নৈতিকতা, মানবিকতা এবং সত্যের পরিপন্থী। প্রতিপক্ষকে শত্রুরূপে দেখা, ঘৃণা-বিদ্বেষে মন ভরানো, ভিত্তিহীন অপপ্রচার ও চরিত্রহননের আশ্রয় নেওয়া- এসব যেন রাজনৈতিক কৌশলের ‘স্বাভাবিক’ অংশে পরিণত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে অযাচিত প্রতিশ্রুতি, অনৈতিক লেনদেন, দলীয় স্বার্থে হিংসা-হানাহানি-সব মিলিয়ে রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এই প্রবণতাগুলো শুধু অসুন্দরই নয়, বরং গভীরভাবে হারাম এবং আত্মিক ধ্বংসের কারণ।
১. নেতৃত্বপ্রত্যাশার নিন্দা:
রাসূলুল্লাহ ﷺ নেতৃত্বের জন্য লোভ করা বা নিজে থেকে পদ কামনা করা সম্পর্কে স্পষ্ট সতর্কতা দিয়েছেন:
“আমরা সেই ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিই না, যে তা কামনা করে বা আগ্রহ দেখায়।”
(সহীহ বুখারি: ৭১৪৯; সহীহ মুসলিম: ১৮২৩)
আরেক বর্ণনায়:
“হে আবু যর! তুমি দুর্বল; আর নেতৃত্ব একটি আমানত। কিয়ামতের দিন এটি অপমান ও অনুশোচনার কারণ হবে—যদি না কেউ এর যথাযথ দায়িত্ব পালন করে।”
(সহীহ মুসলিম: ১৮২৫)
অর্থাৎ নেতৃত্ব হলো ইজ্জতের আসন নয়-বরং ভয়ংকর জবাবদিহির দায়িত্ব।
২. প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করা ইসলামের চরিত্র নয়:
কুরআন মু’মিনদেরকে বলেন:
“কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি তোমাদের বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়বিচার থেকে দূরে না ঠেলে দেয়। ন্যায়বিচার করো-এটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী।”
(সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৮)
অর্থাৎ প্রতিপক্ষ- রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী-তার প্রতি ন্যায়, সম্মান, এবং সত্যনিষ্ঠ আচরণ বাধ্যতামূলক।
৩. মিথ্যা, অপবাদ ও চরিত্রহননের কঠোর নিষেধ:
“হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের মধ্যে উপহাস করো না… একে অপরের দোষ খোঁজো না এবং অপবাদ দিও না।”
(সূরা হুজুরাত, ৪৯:১১)
“অসত্যের প্রতি ঝুঁকো না…।”
(সূরা আল-আন’আম, ৬:১৫২)
রাসূল ﷺ বলেছেন: “মিথ্যার দিকে নিয়ে যায় এমন সবকিছু হারাম। মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে টানে, এবং পাপ তাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।”
(সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)
অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য মিথ্যা- স্পষ্ট হারাম।
৪. হিংসা-বিদ্বেষ ও মারামারি: ইসলামী নৈতিকতার পরিপন্থী
আল্লাহ বলেন: “হে মু’মিনগণ! পরস্পরকে হত্যা করো না।”
(সূরা আন-নিসা, ৪:২৯)
রাসূল ﷺ বলেন: “মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জিহ্বা থেকে মুসলিম নিরাপদ থাকে।”
(সহীহ বুখারি, ১০)
অতএব রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, মারামারি- সবই ইসলামের মূল চরিত্রের বিরুদ্ধে।
৫. অযাচিত ওয়াদা ও অবাস্তব প্রতিশ্রুতির নিষেধাজ্ঞা:
নির্বাচনের ময়দানে ‘অবাস্তব প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে ভোট নেওয়ার প্রবণতা প্রচলিত। অথচ ইসলামে ওয়াদা পূরণ করা ঈমানের অংশ।
“তোমরা প্রতিশ্রুতি পূরণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।”
(সূরা আল-ইসরা, ১৭:৩৪)
রাসূল ﷺ বলেছেন: “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে…।”
(সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)
অতএব অযাচিত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এক ধরনের আত্মিক প্রতারণা।
৬. অন্যায় লেনদেন, ঘুষ ও হক নষ্ট করা:
রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেতে অনৈতিক লেনদেন, অর্থের প্রভাব, অস্বচ্ছ চুক্তি- এসব ব্যাপক। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন:
“তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করো না…।”
(সূরা আল-বাকারা, ২:১৮৮)
রাসূল ﷺ বলেন: “ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়েই জাহান্নামী।”
(সুনান তিরমিজি: ১৩৩৬)
এমনকি কারো হক নষ্ট করে পদ লাভ করাও জুলুম, আর জুলুম সম্পর্কে কুরআন বলে:
“জালিমদেরকে আমি ভালোবাসি না।”
(সূরা আলে ইমরান, ৩:৫৭)
৭. ইসলামী মানদণ্ড: কল্যাণমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্ব
ইসলাম রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ক্ষমতার উৎস নয়- সেবার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার আমানত ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন:
“যারা শাসনক্ষমতায় আসে, তারা ন্যায়বিচার করবে।”
(সূরা আন-নিসা, ৪:৫৮)
ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শ:
* সত্য
* ন্যায়
* আমানতদারিত্ব
* বিনয়
* মানবিকতা
* তাকওয়া
প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে হিংসা, বিদ্বেষ, অপবাদ, মিথ্যা, অযাচিত প্রতিশ্রুতি, অনৈতিক লেনদেন এবং পদলোভে পরিপূর্ণ—এটি ইসলামী নৈতিকতার পরিপন্থী। ইসলামী দৃষ্টিতে নেতৃত্ব একটি ইবাদত; একটি আমানত; একটি গভীর আত্মজবাবদিহির কর্তব্য। যখন রাজনীতি ক্ষমতার লোভ থেকে মুক্ত হয়ে সত্য, সেবা, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে দাঁড়াবে তখনই তা মানবকল্যাণমুখী ও আল্লাহমুখী রাজনীতিতে রূপ পাবে, ইনশাআল্লাহ্। আর এটাই হলো ইসলামী রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি।
IFM desk