আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই-নাকি ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার সহজ পথ খুঁজি? এই প্রশ্নটি আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমাদের বিবেককে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, সোজাসুজি উত্তর দিতে গিয়েই আমরা অস্বস্তি অনুভব করি। কারণ আমরা জানি, এই প্রশ্নের উত্তরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের ভণ্ডামি, আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনার ধারাবাহিকতা। স্বাধীনতার পঞ্চান্ন বছর পর আজ আমরা যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে কেবল শাসকই নয়, শাসিতরাও দায়মুক্ত নয়। যেমন রাজনীতি পচে গেছে, তেমনি সমাজও পচা বীজ লালন করেছে বহু বছর ধরে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট আমাদের উপর থেকে নেমে আসেনি; বরং আমাদের ভেতরের দুর্বলতাই সেটিকে আহবান করেছে।
এ দেশের রাজনীতিবিদরা দেশ ও জাতির কল্যাণের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে—এটি আজ আর কোনো নতুন আলোচনা নয়। কিন্তু এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। ব্রিটিশরা দুই শতাব্দীতে যা করতে পারেনি, এই দেশের একটি অংশের স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদরা মাত্র পাঁচ দশকে তা করে দেখিয়েছে—রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যক্তিগত এজেন্ডা, দলীয় স্বার্থ আর ক্ষমতার নেশায় এমনভাবে বন্দী করেছে যে, দেশের মানুষ তাদের নিজ রাষ্ট্রের উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছে। জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক যেখানে আস্থাভিত্তিক হওয়ার কথা ছিল, সেখানেই জন্ম নিয়েছে ভয়, বঞ্চনা ও বিভাজন।
আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাজনীতি এখন আর আদর্শ বা মূল্যবোধের জায়গা নয়; বরং এটি ক্ষমতা, টাকার লোভ, সামাজিক মর্যাদা এবং আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনীতিতে প্রবেশ করলেই অঢেল সম্পদ, দেহরক্ষী, ক্ষমতার আমলাতান্ত্রিক প্রভাব—এগুলো যেন স্বাভাবিক অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বোধ সম্পন্ন নেতার অভাব নেই—বরং অভাব একজন আদর্শিক, নৈতিক, উদারমনস্ক রাজনৈতিক নেতার, যিনি ক্ষমতার মোহকে ছাপিয়ে মানুষের কল্যাণকে প্রধান্য দেবেন। সমাজে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ অনৈতিকতার সুযোগ যত বাড়ে, সৎ মানুষের প্রবেশ ততই কমে যায়।
জুলাই-আগস্টের ভয়াবহ গণহত্যার পরও যদি সাধারণ মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকে, যদি ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী উভয়ের রাজনীতিবিদই ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে পড়েন, যদি প্রশাসনের কর্মচারীরা সততা বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতিকে বেছে নেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানের সাধনার চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখেন—তাহলে প্রশ্ন উঠবেই, আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? আবারও আমরা সেই ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হব যে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, তখন ব্যক্তির তৃপ্তির উপর পুরো জাতির ভাগ্য নির্ভর করে। আর সেই ব্যক্তিরা যদি লোভ, প্রতিহিংসা এবং অহংকারে অন্ধ হয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র অচিন্তনীয় বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো বছরের পর বছর তাদের কর্মীদের অবৈধ সুবিধা প্রদানের যে সংস্কৃতি তৈরি করেছে, সেটি এখন তাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এই সুবিধা না দিলে যে কর্মীভিত্তি মুহূর্তেই ভেঙে পড়বে তা তারা নিজেরাই জানে। কারণ কর্মীদের একটি বড় অংশ রাজনীতিতে এসেছে দেশ গড়তে নয়—বরং ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা পেতে। এ ধরনের রাজনীতি দেশকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। এতে দেশপ্রেম জন্মায় না, জন্মায় লোভ ও দুর্নীতি।
আজ যারা প্রচলিত রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিক খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মুখে তারা সাধারণ মানুষের কথা বললেও, বাস্তবে তারা নিজেদের সুবিধা, দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার কাঠামো ধরে রাখতেই ব্যস্ত। সাধারণ মানুষ তাদের কাছে কেবল স্লোগানের বিষয়, কিন্তু উন্নয়নের অংশ নয়। ফলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বারবার রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে রুদ্ধ হয়ে যায়, সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে।
যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমানে গড়ে উঠেছে, তা মূলত সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার একটি পদ্ধতিগত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার লক্ষ্য ক্ষমতা বজায় রাখা, সম্পদ লুট করা, মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী মতকে দমন করা এবং জাতির সাধারণ মানুষের বঞ্চনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। আজকের রাজনীতি সাধারণ মানুষকে শোনানোর জন্য কিছু, কিন্তু কার্যত করার জন্য অন্য কিছু। এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় জাতীয় দুর্ঘটনা।
আমাদের দরকার এমন নেতৃত্ব, যারা দলে নয়—মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখেন। যারা জনতার পাশে দাঁড়ান, ক্যামেরার সামনে নয়। যারা সংখ্যার খেলা নয়, নীতির পথে হাঁটতে জানেন। আজ যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র সংকটে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল সংবিধানের পাতায় নয়—মানুষের মন ও চেতনাতেও জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। আর এই জাগরণ ঘটবে তখনই, যখন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নাগরিকদের মধ্যে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ ঘটবে।
রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই বলেন, “আমরা জনগণের জন্য কাজ করি।” কিন্তু সেই জনগণ কারা? তারা কি শুধু শহরের রাজনীতিকর্মী? নাকি সেই কিশোর শ্রমিক যে সারাদিন brick-field এ কাজ করে ৩০০ টাকা আয় করে? সেই কৃষক, যিনি নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেন না? সেই নারী, যিনি ঢাকার দূরবর্তী কোনো হাসপাতালে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা পান না? ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মানুষের গল্প শোনার কেউ নেই। তাদের চোখের ভাষা কোনো নীতি-নির্ধারণের আলোচনায় স্থান পায় না। এই disconnect—এই দূরত্ব—এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকট।
এ দেশে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহৃত শব্দ হলো “গণতন্ত্র।” এটি যেন এক ধরনের ছদ্মবেশ, যার আড়ালে সব অন্যায়ই বৈধতা পায়। অথচ গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়; এটি মানে স্বাধীন মত প্রকাশ, বিরোধী মতের প্রতি সম্মান, ব্যক্তির নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু বাস্তবে ভিন্নমত মানেই রাষ্ট্রবিরোধী, নিরপেক্ষতা মানেই অপরাধ, প্রশ্ন মানেই ষড়যন্ত্র। এমন রাজনীতিতে নাগরিকেরা নিজেদের পরিত্যক্ত ও অসহায় মনে করেন।
একসময় মানুষ বিশ্বাস করত, ক্ষমতার পরিবর্তন মানেই রাজনীতির পরিবর্তন। কিন্তু বাস্তবতা দেখিয়েছে—ক্ষমতা বদলায়, মানুষ বদলায়, কিন্তু রাজনৈতিক আচরণ, ভাষা, মূল্যবোধ বদলায় না। আমাদের রাজনীতিতে আজ যে নৈতিক দেউলিয়াপনা দেখা যাচ্ছে, তা নতুন নয়—বরং দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতার ফল। এর কারণ হলো—আমরা ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকে সাজিয়েছি, নীতিকে নয়।
এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হলে একমাত্র পথ হলো নৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব। এমন নেতৃত্ব যারা জনগণকে ভোটব্যাংক হিসেবে নয়—মানুষ হিসেবে দেখবেন। যারা সত্য কথা বলবেন নিজের দলের ভেতরেও, যারা জাতির সামনে মিথ্যা আশা দেখাবেন না, যারা ক্ষমতার জন্য নয়, ন্যায় ও মূল্যবোধের জন্য লড়বেন। নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়। যেকোনো রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি থাকে তার মানুষের ভেতর। আর মানুষ তখনই জাগে, যখন তারা দেখে তাদের নেতা সত্যিকারের মানুষ।
আমরা এ দেশকে সুস্থ, আধুনিক, সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। রক্তমূল্যে পাওয়া এ দেশকে রাজনৈতিক প্রতারণার নাট্যমঞ্চে পরিণত হতে দিতে পারি না। ২০ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ কোনো দলের ক্ষমতা দখলের খেলায় জিম্মি হতে পারে না। নাগরিক সমাজের দায়িত্ব এখন সবচেয়ে বেশি—তারা যদি দলবাজি, স্বার্থবাদ এবং নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারে, তবে এই দেশের পতন ঠেকানোর কেউ থাকবে না।
আজ প্রয়োজন রাজনীতির পুনঃআবিষ্কার। এমন রাজনীতি, যা দেশের জন্য; দলের জন্য নয়। মানুষের জন্য; ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। মূল্যবোধের জন্য; ক্ষমতার জন্য নয়। সত্যের জন্য; ভয়ের জন্য নয়।
আমরা যদি সত্যিই পরিবর্তন চাই—তাহলে প্রথমেই আমাদের নিজের ভেতরের রাজনীতি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের নৈতিকতা ফিরে পেতে হবে, আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করতে হবে। রাজনীতি তখনই সুস্থ হবে, যখন নাগরিকরা সুস্থ হবে। আর নাগরিক তখনই সুস্থ হবে, যখন তারা বুঝতে শিখবে—দেশ বদলাবে তখনই, যখন আমরা নিজেদের বদলাব।
তাই প্রয়োজন একটিই জিনিস—সচেতন সাধারণ মানুষের জাগরণ। তারা যেন বলেন, “আমাদের রাজনীতি নয়, দেশের জন্য রাজনীতি চাই।” এই উচ্চারণই হবে নতুন বাংলাদেশের প্রথম ধাপ। এখান থেকেই শুরু হবে পরিবর্তনের যাত্রা—একটি নৈতিক, মানবিক, উদারমনা রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে।
লেখক: আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট,
columnistazad@gmail.com