বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন




রূপকথার মহানায়ক পেলে

সাও পাওলোর বস্তি থেকে রূপকথার মহানায়ক পেলে

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ৮:৪৬ pm
FIFA Logo federation international football association FIFA World Cup ফেডারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল এসোসিয়েশন ফিফা Edson Arantes do Nascimento Pele FIFA Football ফুটবলার ফুটবল এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু পেলে ফিফা বিশ্বকাপ Pelé পেলে
file pic

ফুটবলের রাজা নামে তাকে এক নামে চেনে বিশ্বজুড়ে সবাই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ফুটবল পায়ে জাদুকরি স্কিল আর অবিশ্বাস্য সব কীর্তিতে তিনি হয়ে উঠেছেন খেলাটারই প্রতীক। সাও পাওলোর দারিদ্রপীড়িত এলাকায় খালি পায়ে মোজা আর কাগজের ফুটবল দিয়ে খেলতে খেলতে হয়ে উঠেছেন রূপকথার চরিত্র। ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন জীবনের মহানায়ক, অসংখ্য মানুষের প্রেরণার উৎস।

কীর্তিতে যদিও তিনি অমর, তবে এই মর্ত্যের পৃথিবী ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাকে জীবনের নিয়মেই। বর্ণাঢ্য এই জীবনের নানা মোড়ে কীভাবে তিনি এগিয়ে গেছেন জয়ের ঝান্ডা উঁচিয়ে, বিদায় বেলায় ফিরে তাকানো যাক সেই অধ্যায়গুলোতে।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর, তার জন্ম ব্রাজিলের মিনাজ জেরাইস রাজ্যের ত্রেস করাসোয়েসে। মা-বাবা নাম রাখলেন এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয় তার নাম। বাড়িতে সবাই ডাকতেন ‘জিকো’ নামে।

তার বেড়ে ওঠা সাও পাওলোর বাউরুতে। দারিদ্রপীড়িত শৈশবে কিছুটা বাড়তি আয়ের জন্য কাজ করতেন চায়ের দোকানে।

‘পেলে’ ডাকনামটি পান তিনি স্কুলের দিনগুলিতে। সেসময় তার প্রিয় ফুটবলার ছিলেন ভাস্কো দা গামার গোলকিপার ‘বিলে।’ সেই ছেলেবেলাতেই স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি এতটাই ভালো ছিলেন যে, অনেক সময় দুই দলের শক্তির ভারসাম্য রাখার জন্য তাকে গোলকিপিংয়ে দাঁড় করানো হতো। সেখানেও তিনি দারুণ সব সেভ করতেন। তার সঙ্গীরা তখন মজা করে বলত, ‘ও মনে হয় নিজেকে ‘বিলে’ ভাবে।” পেলে নিজে অবশ্য ‘বিলে’ নামটি ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতেন না। অনেকটা শোনাত ‘পেলে’ মতো। সেখান থেকেই ক্রমে ‘বিলে’ বিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘পেলে।’

তখন অবশ্য পেলে নিজে এই নাম একটুও পছন্দ করতেন না। বিজ্ঞানী এডিসনের নামে বাবা-মার দেওয়া নামই তার পছন্দ ছিল। তবে ক্রমে পেলে নামের আড়ালে হারিয়ে যায় তার আসল নাম।

পেলে পরে অনেকবারই বলেছেন, এই নামের কোনো অর্থ তার জানা নেই। ‘বিলে’ শব্দের অর্থ হিব্রু ভাষায় বোঝায় ‘মিরাকল।’

ছেলেবেলায় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের দিনগুলিতেই তার ফুটবল শেখার শুরু। তার বাবা জোয়াও রামোস দো নাসিমেন্তো, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘দন্দিনিয়ো’ নামে, নিজেও ছিলেন ফুটবলার। খেলেছেন ফ্লুমিনেন্সের মতো ক্লাবেও। তবে চোটের ছোবলে চালিয়ে যেতে পারেননি। বাবার কাছেই পেলের ফুটবল শিক্ষার শুরু। বাবাই ছিলেন পেলেন গুরু, মেন্টর ও ট্রেনার।

ছেলেবেলায় আসল ফুটবল কিনতে না পেরে অনেক সময় মোজার ভেতর কাগজ পুরে ফুটবল বানিয়ে খেলেছেন পেলে। কখনও কখনও খেলতেন জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে। শৈশব-কৈশোরে অনেক অ্যামেচার ক্লাবে খেলেছেন তিনি, তার প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে সেসময় থেকেই।

পরে ইনডোর ফুটবলে তিনি দেখাতে থাকেন প্রতিভার ঝলক। ১৪ বছর বয়সেই সেখানে বড়দের সঙ্গে এক টুর্নামেন্টে খেলে তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। অনেক পরে পেলে বলেছিলেন, ইনডোরে খেলে তার গতি, সৃষ্টিশীলতা, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক। তাকে আরও শাণিত করে তুলেছিল।

সান্তোসের আঙিনায়

১৯৫৬ সালে বাউরুর স্থানীয় কোচ ভালদেমার দে ব্রিতো পেলেকে নিয়ে গেলেন সান্তোস ফুটবল ক্লাবে। ১৫ বছর বয়সী কিশোর ফুটবলারকে নিয়ে সান্তোস কর্তৃপক্ষকে তিনি বললেন, “এই ছেলেটাকে দেখুন, একদিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে।”

অনুশীলনে সান্তোসের কোচ লুইস আলোন্সো পেরেস ‘লুলা’ পছন্দ করে ফেললেন কিশোর ফুটবলারকে। ওই বছরে জুনে সান্তোসের সঙ্গে পেশাদার চুক্তি হলো পেলের।

অনুশীলনে ফুটবলের কারিকুরি দেখিয়ে দ্রুতই সান্তোসে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন পেলে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম তাকে প্রচার করতে থাকে ভবিষ্যৎ মহাতারকা হিসেবে।

জুনিয়র দল খেকে দ্রুতই তাকে সিনিয়র দলে তুলে আনা হয় এবং ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক হয়ে যায় তার। করিন্থিয়ান্সের বিপক্ষে ৭-১ গোলের জয়ে সেদিন প্রথম গোলটি করেন পেলেই।

অপ্রতিরোধ্য ছুটে চলা

১৯৫৭ সালে মৌসুমের শুরু থেকেই সিনিয়র দলে নিয়মিত পেলে। চোখধাঁধানো স্কিল আর গোলের পর গোল করে তাক লাগিয়ে দেন। ১৬ বছর বয়সেই সিনিয়র লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে যান।

অবিশ্বাস্যভাবে, প্রথম পেশাদার ফুটবলে পা রাখার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান তিনি। ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই, বয়স তখনও ১৭ পূর্ণ হয়নি, জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক হয়ে যায় তার। মারাকানায় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচটিতে অবশ্য তারা হেরে যান ২-১ গোলে।

তবে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে বদলি হিসেবে নেমে ব্রাজিলের একমাত্র গোলটি করেন পেলে। ১৬ বছর ২৫৯ দিন বয়সে গোল করে এখনও তিনি দেশের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলস্কোরার।

বিশ্বকাপের বিস্ময়

বয়সকে হার মানিয়ে বিশ্বকাপ দলে পেলের জায়গা পাওয়া ছিল অবধারিতই। তবে ব্রাজিল দলের হয়ে সুইডেনে বিশ্বকাপ খেলতে যান তিনি হাঁটুর চোটকে সঙ্গী করে। তার মাঠে নামা নিয়েই ছিল তীব্র শঙ্কা। দলে রাখা নিয়েও ছিল টানাপোড়েন। তবে সতীর্থ অনেকের চাপে মূলত তাকে রাখা হয় দলে। ১০ নম্বর জার্সি দেওয়া হয় তাকে। যে জার্সি পরে হয়ে ওঠে তার প্রতীক, সেই জার্সির সঙ্গে সখ্য এই বিশ্বকাপ থেকেই।

অনেকটা নাটকীয়ভাবে সুস্থ হয়ে তিনি খেলতে নামেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। সে সময় বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার ছিলেন তিনি। গোল না পেলেও ওই ম্যাচে গোলে অবদান রাখেন তিনি, প্রতিভার জাদুও দেখান কিছু।

কোয়ার্টার-ফাইনালে পেলের গোলেই ওয়েলসকে হারায় ব্রাজিল। সেমি-ফাইনালে ফেভারিট ফ্রান্সকে ৫-২ গোলে উড়িয়ে দেয় ব্রাজিল, পেলে করেন হ্যাটট্রিক।

ফাইনাল খেলতে নেমেই একটি রেকর্ডে নাম লেখা হয়ে যায় তার। বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হয়ে যান তিনি ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে। শুধু মাঠে নামার রেকর্ডেই তো তিনি তৃপ্ত থাকার মতো নন। স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে ৫-২ গোলের জয়ে তিনি গোল করেন দুটি।

সুইডিশ এক ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে ফ্লিক করে এরপর ভলিতে নিজের প্রথম গোলটি করেন তিনি। সেই গোলকে এখনও মনে করা হয় ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলগুলির একটি। শেষ বাঁশি বাজার পর আনন্দ-কান্নায় ভেঙে পড়েন পেলে। তাকে ঘিরেই চলতে থাকে সতীর্থদের উদযাপন।

রূপকথার নায়ক

বিশ্বকাপ দিয়ে ব্রাজিলের সীমানা ছাড়িয়ে পেলের জাদু ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বৈশ্বিক মহাতারকা রূপে আবির্ভুত হন তিনি। হয়ে ওঠেন লাখো-কোটি মানুষের নায়ক ও প্রেরণার উৎস।

আরেকটি সেরা

১৯৫৯ সালে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে (এখনকার কোপা আমেরিকা) সর্বোচ্চ গোলস্কোরার ও সেরা ফুটবলারের খেতাব জেতেন তিনি।

অবিস্মরণীয় গোল ও জাতীয় সম্পদ

১৯৬১ সালে সান্তোসের হয়ে ফ্লুমিনেন্সের বিপক্ষে এমন এক গোল করেন, যা চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসে। অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ সেই গোলকে অনেকে মনে করেন ফুটবল ইতিহাসের সুন্দরতম গোল।

তাকে ঘিরে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবের তুমুল আগ্রহ। সান্তোস ছেড়ে তার ইউরোপে চলে যাওয়া নিয়েও চলে নানা গুঞ্জন। সেই চলে যাওয়া ঠেকাতে ১৯৬১ সালেই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পেলেকে ঘোষণা করে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে। পেলে হয়ে ওঠেন সুন্দর ফুটবলের প্রতীক।

বিশ্বমঞ্চে চোটের থাবা

১৯৬২ বিশ্বকাপ খেলতে যখন চিলিতে যান পেলে, বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে তিনি তখন প্রায় সবার কাছে স্বীকৃত। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে দলের প্রথম গোলে অবদান রাখেন তিনি, পরে নিজে অসাধারণ এক গোল করেন চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে।

পরের ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে দূরপাল্লার এক শট নিতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। চোট পেয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যান তিনি। গারিঞ্চার দুর্দান্ত নৈপুন্যে অবশ্য বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল।

হতাশার বিশ্বকাপ

ব্রাজিল ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে খেলতে যায় টুর্নামেন্টের ফেভারিট হিসেবে। পেলে তখন বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান ফুটবলার। তারকায় ঠাসা গোটা দলই। তবে তাদেরকে থামাতে প্রতিপক্ষ বেছে নেয় নির্মম ফাউলের পথ। চোটাক্রান্ত হন পেলেও।

প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে গারিঞ্চার গোলে ব্রাজিল এগিয়ে যাওয়ার পর ফ্রি কিক থেকে গোল করেন পেলে। প্রথম ফুটবলার হিসেবে কীর্তি গড়েন টানা তিন বিশ্বকাপে গোল করার। তবে বুলগেরিয়ান ফুটবলারদের একের পর এক ফাউলে চোট পেয়ে পেলে খেলতে পারেননি পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে। চোটজর্জর দল হেরে যায় সেই ম্যাচে।

পরের ম্যাচে টিকে থাকার লড়াইয়ে আনফিট পেলেকেই নামিয়ে দেন কোচ। ওই ম্যাচে তাকে ভয়ঙ্কর এক ফাউল করেন পর্তুগিজ ডিফেন্ডার জোয়াও মোরাইস। কিন্তু রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখাননি, এখনও যেটিকে মনে করা হয় বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্তগুলির একটি। পরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলে কিছু করতে পারেননি পেলে। ম্যাচ হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল।

বাদ পড়ে অভিমান করে পেলে বলেন, আর কখনও বিশ্বকাপে খেলবেন না তিনি। যদিও পরে বদলে ফেলেন সেই সিদ্ধান্ত।

ফুটবলের রাজা থামালেন যুদ্ধ

১৯৬৯ সালে আফ্রিকা সফরে বের হয়েছিল সান্তোস ফুটবল ক্লাব। একটি ম্যাচ ছিল নাইজেরিয়ায়, যেখানে তখন চলছিল রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। মারা পড়ছিল হাজার হাজার মানুষ। যথাযথ নিরাপত্তা পাওয়ার শর্তেই কেবল সেখানে যেতে রাজি হয়েছিল সান্তোস।

যুদ্ধে উন্মত্ত নাইজেরিয়ানরাও তখন শান্ত হয়ে গিয়েছিল। পেলের খেলা দেখতে যুদ্ধ বিরতি দেওয়া হয়েছিল ৪৮ ঘণ্টার! লাগোসে ২-২ গোলে ড্র হওয়া সেই ম্যাচে দ্বিতীয় গোলটি করেন পেলে।

অবিশ্বাস্য উচ্চতায়

সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে নিজের হাজারতম গোলটি করেন পেলে ১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর। গোটা ব্রাজিল অপেক্ষা করছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। ভাস্কো দা গামার বিপক্ষে ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোলটি করেন তিনি। গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় তাকে। সেই গোল বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ও মিলেসিমো’ বা ‘দা থাউজ্যান্ডথ’ গোল নামে।

তৃতীয় বিশ্বকাপ

১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল দল থেকে অনেকটা সময় দূরে ছিলেন পেলে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে খেলা নিয়েও দ্বিধায় ছিলেন। পরে অবশ্য খেলার সিদ্ধান্ত নেন। বাছাইপর্বে ৬ ম্যাচে করেন ৬ গোল।

মূল আসরেও যথারীতি চলতে থাকে তার রাজত্ব। প্রথম ম্যাচে এক গোল করার পর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে করেন দুই গোল। পরে ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে দলের প্রথম গোলটি করেন তিনি। হেড থেকে গোল করে সতীর্থ জেয়ারজিনিয়োর বাহুবন্দি হয়ে উচ্ছ্বাসে হাত উঁচিয়ে ধরা পেলের ছবিটি শুধু ফুটবল নয়, যে কোনো খেলার সবচেয়ে ‘আইকনিক’ ছবিগুলোর একটি মনে করা হয়।

পরে আরও দুটি গোলে অবদান রাখেন পেলে। ৪-১ গোলের জয়ে বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফি নিজের করে নেয় ব্রাজিল।

প্রথম ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের অংশ হন পেলে, এখনও তিনি যেখানে অনন্য।

ব্রাজিলের জার্সিতে শেষবার

আন্তর্জাতিক ফুটবলে পেলে শেষবারের মতো মাঠে নামে ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ইতি টানেন ব্রাজিলের জার্সিতে তার গৌরবময় অধ্যায়ের।

নতুন অধ্যায়

১৯৭৪ মৌসুমের পর সান্তোসের হয়ে তার নিয়মিত দেখা যায়নি পেলেকে। মাঝেমধ্যে অবশ্য দু-একটি ম্যাচে খেলেছেন। তবে অনেকটা অবসরের মতোই ছিল বলা চলে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ফুটবল বিশ্বে তুমুল আলোড়ন তুলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে নাম লেখান নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবের হয়ে। নতুন ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচেই করেন গোল।

যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং ফুটবল বিশ্বে পরিচিত করে তোলায় বড় কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাকে। তাকে অনুসরণ করে পরে আরও অনেক বড় তারকা পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, যে ধারা চলে আসছে আজও।

অবশেষে অবসর

১৯৭৭ সালে কসমস ও সান্তোসের মধ্যে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ দিয়ে খেলোয়াড়ি জীবনের পথচলা আনুষ্ঠানিকভাবে থামান পেলে। ম্যাচের দুই অর্ধে তিনি খেলেন তার দুই ক্লাবের হয়ে। ঠাসা গ্যালারির দর্শক তালিকায় তার বাবা, স্ত্রী, পরিবারের অন্যরা ছাড়াও ছিলেন মোহাম্মদ আলি, ববি মুরসহ আরও অনেক তারকা।

ফুটবল ও সীমানা ছাড়িয়ে

ইউনিসেফের হয়ে শিশুসুরক্ষায় কাজ করার জন্য ‘আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয় পেলেকে।

১৯৮১ সালে ‘এস্কেপ টু ভিক্টরি’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক হয় ফুটবলের রাজার।

১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের হল অব ফেম-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় থাকে। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্তোর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৫ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ফুটবল ও ক্রীড়াক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে নানা পদক্ষেপ নেন তিনি, প্রণয়ন করেন আইন, যা পরিচিত পেয়ে যায় ‘পেলে আইন’ নামে। ১৯৯৮ সালে পদত্যাগ করেন এই দায়িত্ব থেকে। ১৯৯৭ সালে পান বৃটেনের রানীর দেওয়া সম্মানসূচক ‘নাইটহুড খেতাব।

ব্যালন দ’র জয়ী ফুটবলারের মধ্যে শতাব্দী সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন তিনি ১৯৯৯ সালে। একই বছরে পান ওয়ার্ল্ড সকারের শতাব্দী সেরা ফুটবলারের সম্মান, বার্তাসংস্থা রয়টার্স ও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চোখে ‘অ্যাথলেট অব দা সেঞ্চুরি।’ ফিফার শতাব্দী সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পান পরের বছর।

এছাড়াও অসংখ্য খেতাব, অর্জন, স্বীকৃতি পান তিনি নানা সময়ে।

গত জুনে তিনি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে খোলা চিঠি লেখেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে।

অন্যলোকে

ক্যান্সারের সঙ্গে তার লড়াই চলছিল অনেক দিন ধরেই। হাসপাতালেও যেতে হয়েছে প্রায়ই। কখনও কখনও অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়েছে। অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর হাসপাতালে থেকেই তিনি চলে গেলেন সবকিছুর উর্ধ্বে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD