বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০৯:৪৭ অপরাহ্ন




সিপিডির বই উন্মোচন অনুষ্ঠান

উন্নয়ন ও স্থায়ী দুর্নীতি পাশাপাশি এগিয়েছে

আউটলুকবাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ ৪:২২ pm
CPD logo CPD Centre for Policy Dialogue CPD সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি
file pic

৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি স্থায়ী দুর্নীতিও এগিয়েছে। উন্নতি আর দুর্নীতি দুটোই পাশাপাশি এগিয়েছে। সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যারাডক্স বা আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয় এবং এই উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে হয়নি, বরং প্রথাগতভাবেই দেশের উন্নয়ন হয়েছে। বিভিন্ন নিয়ামকের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ-ইকোনমি, পলিটিক্স, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনু্ষ্ঠানে বইয়ের লেখকরা এসব মন্তব্য করেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান।

বাংলাদেশের ৫০ বছর নিয়ে বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, দেশে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মিলন হয়েছে। সরকার ও বাজারের মধ্যে একধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। ফলে সম্পদ বা সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এত দিন দেশের উন্নয়নের যেসব চালিকা শক্তি ছিল, সেগুলো যে চিরকাল একইভাবে থাকবে, তা নয়। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলো আর থাকবে না। বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে যেতে হবে।

বইয়ের একটি অংশের লেখক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ৫১ বছরে বিভিন্নভাবে আর্থ-সামাজিক উত্তরণ হয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে কয়েকটি বিষয় দ্বিতীয় প্রজন্মকে চ্যালেঞ্জের সামনে নিয়ে গেছে। মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আমরা সামনে টেকসই হব কি-না, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ব কি-না সেটিই এখন চিন্তার বিষয়। তিনি আরও বলেন, আমরা যে রপ্তানি দেখি তাতে উচ্চ কারিগরি উপাদান মাত্র ১ শতাংশ, কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামে তা ২৫ শতাংশের বেশি। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্রাজিল-ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো এখনো মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে আছে।

বইয়ের আরেক লেখক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি। প্রবৃদ্ধির চালকগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক ফাংশন হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা ধোঁয়াশায় আছি, আমরা কি এফডিআই নিয়ে এগোব নাকি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে এগোব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন সংস্কার জরুরি, বাংলাদেশে স্ট্যাবল করাপশন বা স্থায়ী দুর্নীতি উন্নতির সঙ্গে একইভাবে এগিয়েছে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের ভাঙার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ব্যাংকে ও বিচারব্যবস্থায় আমরা উন্নতি করার বদলে নিম্নগামিতা দেখেছি। এখন আমাদের সংস্কার জরুরি।

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ হলেও উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে এটি আর সেভাবে কাজ করবে না বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এত দিন এক ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল, অর্থাৎ এটা চলতে দিতে হবে। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ কি এফডিআই নির্ভর হবে, না কি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন করবে, তা নিয়ে ঐকমত্য নেই। সেলিম রায়হান আরও বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে একধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এই চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা না হলে সংস্কার হবে না; তা না হলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতাও বাড়বে না।

আরেক লেখক এম এম আকাশ বলেন, দরিদ্রতার হার কমা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অসমতা বেড়েছে কেন আমি তা বইয়ে লেখার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে গরিবের উন্নতি শামুকের গতিতে আর ধনীদের রকেট গতিতে হয়েছে। শ্রমিকের গড় উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে সে হারে মজুরি বাড়েনি। দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন গড় সূচক নিয়ে কথা বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না বলে মনে করেন এম এম আকাশ। তিনি বলেন, দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সূত্রে তিনি বলেন, দেশে যেমন অসমতার হার সবচেয়ে বেশি, তেমনি ধনীদের ধন সঞ্চয়ের হারও অনেক বেশি। সে জন্য ধনী ও গরিবের সূচক পৃথকভাবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর বলেন, অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির বাইরে আরও কিছু বিষয় দেশের উন্নয়নে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সেটা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিপ্লব; মানুষের মধ্যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা বা লড়াই করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা। এই প্রবণতার কারণে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের উন্নয়নের জগতে বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে বলে মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। সেটা হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক দূরদৃষ্টি থেকে বর্জনকামী দূরদৃষ্টি। সে জন্য তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় রূপান্তরিত হবে। জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্নীতি এখন ধনীদের মূল এজেন্ডা। তারা দুর্নীতি করে নিজের নিরাপত্তার জন্য। তিনি বলেন, আমরা এখন সস্তা শ্রমে আটকে গেছি। আগামীর অর্থনৈতিক এজেণ্ডা হতে হবে রাজনৈতিক।

অনুষ্ঠানের প্রথম ভাগে বইটির অর্থনীতিবিষয়ক ছয়টি প্রবন্ধের লেখক আলোচনা করার পর তার পর্যালোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কীভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে। জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আমরা যেমন উঠতে পারি, তেমনি পিছলেও যেতে পারি। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উন্নয়ন হয়েছে ভবিষ্যৎকে বন্ধক রেখে। আমরা উঠতেও পারি পিছলাতেও পারি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। তখন অর্থনীতি নিয়ে অতটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে; বরং অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। তিনি আরও বলেন, পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটা হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।

বইটির বিভিন্ন অধ্যায় যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সশরীরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে; উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার; এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন।

সৈয়দ আখতার মাহমুদ আরও বলেন, দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে, তা নয়; বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এই সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আগে এই বিষয় যেভাবে কাজ করত, এখন সেভাবে করছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দেশের মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়েই উন্নয়ন হলেও যাঁরা এই শ্রম দিয়েছেন, তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল হাসান। বলেন, শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়ন অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পশ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি। এ ছাড়া যাঁরা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, তাঁরা নানা ধরনের হয়রানি ও অধিকারহানির শিকার হচ্ছেন।

পরবর্তী চ্যালেঞ্জ
বইটির আরেকজন লেখক সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দ্বৈত উত্তরণের প্রসঙ্গে বলেন, দেশের যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এই উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কি না। শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি এক শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD