সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৮ অপরাহ্ন




রোগী রেফার্ড, হিমশিম খাচ্ছে রংপুর মেডিকেল কলেজ

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫ ৭:০৫ pm
Rangpur Medical College RpMC রংপুর মেডিকেল কলেজ রমেক হাসপাতাল সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়
file pic

বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন মোজাম্মেল হক (৯৭)। কিন্তু সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছে ধারণা থেকে তাকে রেফার্ড করা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তি হবার পর কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে কিছুটা বিলম্বিত হলেও চিকিৎসকরা তার উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে পরদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফেরেন মোজাম্মেল হক।

বর্তমানে চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় ওষুধ সেবন ও নিয়ম মেনে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন তিনি। অসুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে তাকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেওয়া হয়েছিল। পরে সেখান থেকে রেফার্ড করলে অ্যাম্বুলেন্সে বিভাগীয় শহর রংপুরে নেওয়া হয়। গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া-আসায় তাকে গুনতে হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই তার চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল।

মোজাম্মেল হক রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বাসিন্দা। তার পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকরা একটু আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে তাদের রোগীকে রংপুরে যেতে হতো না। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াসহ বাড়তি ব্যয়ও করতে হতো না। উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট, নেই প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব এবং উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা সরঞ্জাম না থাকায় অনেকেই কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর সুযোগ নিচ্ছেন কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। তবে একটু জটিলতা মনে হলেই দায়সারা চিকিৎসা দিয়ে কোনো রকমে রোগীকে অন্যত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে কমতি নেই তাদের।

এই চিত্র শুধু পীরগাছাতেই নয়। জেলার পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, কাউনিয়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও চিকিৎসাসেবা নিয়ে এমন অভিযোগ রয়েছে শত শত রোগী ও তাদের স্বজনদের। আর রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলাগুলোতে চিকিৎসাপ্রাপ্তি যেন সোনার হরিণ। দায়সারা চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঝুঁকি এড়াতে রেফার্ড নির্ভরতা, অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট, সেবা পেতে বকসিস বাণিজ্য ও পথেপথে ভোগান্তি যেন নিত্যদিনের ঘটনা।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদক জেলার বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন। কথা বলেছেন রোগী, স্বজন, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে চিকিৎসক সংকট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকা, জনবল ঘাটতি, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভরতা বৃদ্ধিসহ সমন্বিত উদ্যোগের অভাবের কথা।

শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী রমেক হাসপাতালে

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল রংপুর বিভাগের সকল মানুষের চিকিৎসাসেবার অন্যতম ভরসাস্থল। এই হাসপাতালটি ১৯৬৮ সালে ৬৫ একর জমির ওপর ২৫০টি শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এক দশক পর ১৯৭৬ সালে হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এর সতেরো বছর পর ১৯৯৩ সালে আরও ১০০ শয্যা বর্ধিত করে ৬০০ শয্যায় রুপান্তরিত এবং সবশেষ ২০১০ সালে ১০০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।

বর্তমানে বিভাগীয় পর্যায়ের এই হাসপাতালে ১৮০০-২২০০ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। কখনো কখনো তা ২৫০০ ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১২০০-১৪০০ জন রোগী এবং জরুরি বিভাগে ৪০০-৫০০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। এখানে আছে ইনডোর বিভাগ, আউটডোর বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস।

রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত এই হাসপাতালটিতে বিভিন্ন সময় শয্যা সংখ্যা এবং চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ালেও সেই তুলনায় জনবল বাড়ানো হয়নি। কিছু চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়ালেও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির ঘাটতি এবং জনবল সংকটের অভিযোগ থেকে বের হতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালটিতে আধুনিক সিসিইউসহ মোট ৪২টি ওয়ার্ড, ১২টি অপারেশন থিয়েটার-ওটি, ১০ শয্যার আইসিইউ, ২৫ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট, ৬ শয্যার ডে-কেয়ার ইউনিট, ভায়া সেন্টার, ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেন্টারে চলছে রোগীদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। সেবার মানোন্নয়নে চালু রয়েছে নেফ্রোলজি ওয়ার্ড। এছাড়াও নির্মাণাধীন ১৭ তলা বিশিষ্ট ৪৬০ শয্যার ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগ ইউনিটে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির কাজ চলমান রয়েছে

মেডিসিন বিভাগে রোগীর চাপ বেশি

নির্ধারিত শয্যার চেয়ে হাসপাতালজুড়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী প্রতিদিনই ভর্তি থাকে। এরমধ্যে সবেচেয়ে বেশি রোগীর চাপ থাকে মেডিসিন বিভাগের পাঁচটি ওয়ার্ডেই। এই বিভাগের পাঁচটি ওয়ার্ডে ২৩৫টি শয্যা বরাদ্দ থাকলেও সবসময় ৫০০ এর ওপরে রোগী থাকে। এর অন্যতম কারণ রংপুর বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে রংপুরের এই হাসপাতালটি হচ্ছে টার্সারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যদিও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। তারপরও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক বেশি।

চিকিৎসকরা বলছেন, মেডিসিন ওয়ার্ডে বেশিরভাগ প্রেসার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, আনকন্ট্রোল ডায়াবেটিস, হার্ট ফেইলোর রোগীরা বেশি থাকে। এছাড়া সংক্রমণ ব্যধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কম নয়। এই হাসপাতালে রোগীরা আউটডোর, বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ হয়ে ভর্তি হতে পারে। অনেক সময় সামান্য সমস্যা নিয়ে আসেন রোগীরা, যার চিকিৎসাসেবা জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সম্ভব।

রেফার্ড বাণিজ্যের অভিযোগ, বাড়ছে দুর্ভোগও

অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাদের পছন্দের হাসপাতালে ভর্তি হতেও উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। কোথায় কি ধরনের রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে থাকে তাও রোগী কিংবা তার সঙ্গে থাকা স্বজনদের কৌশলে বলেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এটি চিকিৎসকরা সরাসরি না করলেও হাসপাতাল ও ক্লিনিকের স্টাফরা করে থাকেন বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সামনে কথা হয় এক রোগীর স্বজনের সাথে। জিন্নাত কবির নামের এই ব্যক্তি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে তার ছোট বোনকে নিয়ে এসেছেন। এর আগে প্রসব ব্যথা নিয়ে তিন দিন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন তার বোন। কিন্তু অবস্থা বেগতিক মনে হওয়ায় এবং সিজার ছাড়া সন্তান প্রসবের আকাঙ্খা থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে রংপুরে রেফার্ড হয়ে আসেন।

জিন্নাত কবির বলেন, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ চাইলে সেখানেই স্বাভাবিক ডেলিভারি করাতে পারতো। কিন্তু তা না করে সিজার করানোর ব্যাপারে তারা আমাদের বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে। একপর্যায়ে সেখানকার এক চিকিৎসক রংপুরের গাইনি ডাক্তার মুনমুনকে দেখানোর পরামর্শ দেন। এবং আমরা সেই পরামর্শে ডাক্তার মুনমুনকে দেখানোর পর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করা হয়। আল্লাহর রহমতে এভাবে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। মা এবং নবজাতক শিশু ভালো রয়েছে।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা থেকে এসেছেন নুরুল ইসলাম। তার বড় ভাইয়ের শ্বশুর দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত। পঞ্চগড় এবং দিনাজপুরে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দিনাজপুর মেডিকেল হাসপাতালে কিছুদিন ভর্তি ছিলেন। সেখানে আইসিইউতে শয্যা না পাওয়ায় রেফার্ড হয়ে রংপুরে আসেন। আসার সময় হাসপাতালের স্টাফদের ফাঁদে পড়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হন তারা।

নুরুল ইসলাম বলেন, দিনাজপুর থেকে আসার সময় সেখানকার স্টাফরা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। বকসিস ছাড়া কাগজপত্র দিতে বিলম্ব করেছে। পরে তাদেরকে বকসিস দিয়েছি। শুধু তাই নয় তাদের পছন্দ মতো অ্যাম্বুলেন্সে করে এসে ভাড়া বেশি গুনতে হয়েছে। এক স্টাফ একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়েছে, যাতে রংপুরে তার পছন্দের ডাক্তারের কাছে যাই। সবমিলিয়ে রংপুরে আসার দুদিন হলো এখনো আমরা আইসিইউতে রোগীকে নিতে পারিনি। এখানকার ডাক্তাররা বলছেন, রোগীর আইসিইউতে রাখার মতো অবস্থা হয়নি। অথচ সেখানে (দিনাজপুরে) কিছু স্টাফ ভয় দেখিয়েছে আইসিইউতে না নিলে নাকি রোগী মারা যাবে।

সরকারি আইসিইউতে স্থান না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হন বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে। কিন্তু সেখানে প্রতি রাতের বিলই ১৫-২০ হাজার টাকা। ফলে চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অনেক পরিবার। অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র রোগীদের প্রাণ হারাতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে।

বাইরে থেকে কিনতে হয় বেশির ভাগ ওষুধ

নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বাসিন্দা মমিন মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডায়ালাইসিস করাচ্ছি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। শুরুর কিছুদিন হাসপাতাল থেকে ডায়ালাইসিসের সবকিছু দিত। এখন দুই-একটি জিনিস ছাড়া আর কিছু দেওয়া হচ্ছে না।

জানা গেছে, সরকারিভাবে একজন রোগী ডায়ালাইসিস করতে সর্বোচ্চ খরচ হওয়ার কথা ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা। সেখানে ডায়ালাইজার, ব্লাড লাইন, হ্যাপারিং মেশিনসহ অন্য উপকরণ কিনতে বাড়তি খরচ হচ্ছে ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা পর্যন্ত। একজন রোগীকে সপ্তাহে কমপক্ষে দুইবার ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করে দায়িত্বরত এক নার্স বলেন, ডায়ালিসিস করতে একজন রোগীর রেনাল কেয়ার ফ্লুয়িড (এ পার্ট, বি পার্ট), ডায়ালাইজার, ব্লাড টিউবিন সেট, ফেমোরাল ক্যাথেটার, হেপারিন ইনজেকশন, কটসন ইনজেকশন, ২০ শতাংশ গ্লুকোজ ইনজেকশনসহ ১০ থেকে ১২ ধরনের ওষুধ প্রয়োজন হয়। তবে হাসপাতালের সরবরাহ না থাকায় বেশির ভাগ ওষুধ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, যতবারই ডায়ালাইসিস করা হবে প্রতিবারই রেনাল কেয়ার ফ্লুয়িড, ডায়ালাইজার, ব্লাড টিউবিন সেট, হেপারিন ইনজেকশনসহ ১০ থেকে ১২ ধরনের ব্যয়বহুল ওষুধ ও সরঞ্জাম দরকার।

ঠাকুরগাঁওয়ের সালন্দর এলাকার বাবু নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমার মায়ের দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। রংপুর গিয়ে ডায়ালাইসিস করতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়া যদি চালু থাকত তাহলে আমাদের খরচ ও দুর্ভোগ অনেক কমে আসবে।

বালিয়াডাঙ্গী থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আসমা বেগম বলেন, কয়েক দিন ধরে আমি খুবই অসুস্থ থাকায় চিকিৎসা নিতে ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলাম। গাইনি ডাক্তার না পাওয়ায় একজন দালালের সঙ্গে গিয়ে ক্লিনিকে চিকিৎসা নিই। এতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

বকশিশ সিন্ডিকেটে অতিষ্ট রোগী

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিনামূল্যের ওষুধ না দেওয়া, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশি দামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য করা, পদে পদে আয়া-সেবিকাদের টাকা দেওয়ার এসব অভিযোগ নিত্যদিনের। এমনকি লাশ নামিয়ে দেওয়ার পর স্বজনদের কাছে জোর করে টাকা নেওয়ার ঘটনাও ঘটে এই হাসপাতালে। এসব অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও কোনো প্রতিকার মেলে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

রোগীদের অভিযোগ, বকশিশ না পেলে রোগীর স্বজনদের ওপর চড়াও হওয়া থেকে শুরু করে মারধরের ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। এখানকার কর্মচারী, দালাল এবং বিভিন্ন পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ‘বকশিশ সিন্ডিকেট’ চক্রের সদস্যদের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সবাই যেন জিম্মি।

সম্প্রতি হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্সে বাবার লাশ নিয়ে উঠেছেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার সরওয়ার রহমান। পাশে পড়ে ছিল ওয়ার্ড থেকে লাশ বহন করে আনা স্ট্রেচার। এটি বহন করে আনা আয়া টাকা ছাড়া নড়বেন না। এদিকে ভাড়ার চেয়ে বেশি দাবি করে বসেন অ্যাম্বুলেন্স চালক। এত বাধা পেরিয়ে কী করে বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, এ নিয়ে ভাবছিলেন সরওয়ার। পরে আয়াকে ১৫০ টাকা দেন। আর অ্যাম্বুলেন্স চালককে সাড়ে ৭ হাজার টাকা ভাড়ায় চিলমারী যেতে রাজি করান।

সরওয়ার রহমান বলেন, হাসপাতালে আসার পর থেকে পদে পদে খরচ করেছি। ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা না পেয়ে আমার বাবা মারা গেলেন। শেষে লাশ নিয়ে যেতেও এখানে বকশিশ দিতে হয়। চিলমারী থেকে কুড়িগ্রাম হয়ে তারপর রংপুরে এসেছি, শুধু একটু ভালো অবস্থায় বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায়। কিন্তু সবখানেই টাকা ছাড়া কেউ নড়ে না।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন ঘটনা নতুন নয়। রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর লাশ বের করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। বছরের পর বছর এভাবে সিন্ডিটেকের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ট রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা স্বজন। এমন লাগামছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের।

অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সিন্ডিকেট রয়েছে। ইদানিং তাদের সঙ্গে বাইরের কিছু মানুষ যোগ দিয়েছে।

যেসব কারণে বাড়ছে রেফার্ড

জেলা বা সদর হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন রোগের কনসালটেন্ট আছে। কিন্তু ১০০ থেকে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ইনডোর মেডিকেল অফিসার নেই। একটা হাসপাতালে যদি সব বিভাগ মিলে দুইশো-তিনশো রোগী ভর্তি থাকে, তাহলে এসব রোগীকে অফিস সময়ের বাইরে দুইটা বা আড়াইটার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত সার্ভিস দেওয়ার জন্য ইনডোর মেডিকেল অফিসারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু জেলা হাসপাতালগুলোর অর্গানোগ্রামে মেডিকেল অফিসার নেই। ফলে কনসালটেন্ট ও নার্সের ওপর ভরসা করতে হয়।

‘কনসালটেন্টরা হাসপাতালে অফিস টাইমে রাউন্ড দেন, তারা রোগীর রোগ নির্ণয়, চিকিৎসাপত্র লিখেন, অপারেশন করেন, মানে কনসালটেন্টই সর্বেসর্বা। সাথে নার্সরা রোগীদের ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দেন। মাঝে আর কোনো ডাক্তার নেই। এই সীমাবন্ধতা না থাকলে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো থেকে ৫০ ভাগ রোগী রেফার্ড হতো না। এমনটাই মনে করছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ডায়াবেটোলজিস্ট ডা. মো. মোস্তফা আলম বনি।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মো. মোস্তফা আলম বনি বলেন, জেলা হাসপাতালে এই সার্ভিস না থাকার কারণে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার অনেক চাপে থাকেন। সেই ডাক্তার ইমার্জেন্সিতে রোগী দেখে আবার ইনডোরে যদি ভর্তি থাকা ১০০-১৫০ রোগী দেখার চেষ্টা করেন, সেটা ৪-৫ ডাক্তার থাকলেও কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মেডিকেল অফিসারের অপ্রতুলতার কারণে বা অর্গানোগ্রাম না থাকার কারণে জেলা হাসপাতালগুলো থেকে রোগী রেফার্ড হচ্ছে।

চিকিৎসক বিন্যাসে প্রয়োজন অর্গানোগ্রাম

রেফার্ডের প্রবণতা কমিয়ে আনতে এবং সেবার মানোন্নয়নে সরকারকে চিকিৎসা খাত ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ নিতে হবে মনে করেন মোস্তফা আলম বনি। শুধুমাত্র চিকিৎসকের ওপর দায় না চাপিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থায় হাসপাতালগুলো কি রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাও জনসাধারণকে উপলব্ধি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল অফিসাররা ২৪ ঘণ্টা থাকেন। সেখানে কনসালটেন্ট থাকার বিধান নেই। মেডিকেল অফিসাররা রোগীর যদি যথাযথ টেককেয়ার করেন তাহলে এতবেশি রেফার্ড হওয়ার কথা নয়। তবে উপজেলা পর্যায়ে যতটুকু সেবা দেওয়ার সীমাবন্ধতা আছে তার চেয়েও বেশি সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার রোগী বা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের যেরকম আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা সেই তুলনায় সেবা দেওয়াটা সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে অনেক সময় প্রয়োজন ছাড়া, কখনো প্রয়োজনে এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকে ডাক্তাররা রেফার্ড করে থাকেন। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের বিন্যাসে অর্গানোগ্রাম দরকার।

বেসরকারি হাসপাতালেও বাড়ছে রেফার্ড

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে ধকল কমাতে অনেকেই পা বাড়ান বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। উন্নত চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা থাকায় রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল, মাউন্ট প্যাসেফিক হাসপাতাল, গুড হেলথ্সহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা।‌‌

বিশেষ করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোলঘেষে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল থাকায় একটি চক্র রোগীদের নানাভাবে সেগুলোতে রেফার্ড হতে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এক্ষেত্রেও হাসপাতালের স্টাফদের পাশাপাশি কখনো কখনো সরাসরি চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন অন্যত্র রেফার্ড হতে। কারণ অনেক চিকিৎসক নির্ধারিত সময়ের বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে রোগী দেখেন। কোথাও কোথাও তাদের আলাদা চেম্বারও রয়েছে।

রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে গড়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী রেফার্ড হয়ে আসেন। এরমধ্যে সরকারি হাসপাতালের রোগীও রয়েছে। এছাড়া, প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ জন রেফার্ড হন।

হাসপাতালের পরিচালকের বক্তব্য

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, সমস্যা অনেক। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সব সমস্যার সমাধান তো চাইলেই সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট নেই বলব না, তবে তাদের দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে অনেক কমানো গেছে।

তিনি আরও বলেন, রোগীর তুলনায় শয্যা সংখ্যা অনেক কম। সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসক ও জনবল সংকটের পাশাপাশি অনেকগুলো চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। নানা সীমাবন্ধতার মধ্যেও আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু প্রতিদিন রোগীর চাহিদা অনেক বেশি থাকে। ঢাকা পোস্ট




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD