কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা চলছে স্বর্ণের বাজারে। দেশেও এর আঁচ লেগেছে। গত দুই বছরেই দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। রেকর্ড গড়ে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম দুই লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দাম অনেক বেশি। ফলে দেশে কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তবে বাজুসের নেতারা বলছেন, স্বর্ণ একটি মূল্যবান স্থায়ী সম্পদ। ফলে বিশ্বের কোনো দেশে যুদ্ধ কিংবা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি দেখা দিলে এর দামে এক ধরনের প্রভাব পড়ে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধ, ট্রাম্পের শুল্কনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের সুদ হ্রাস– এসব কারণে সামনের দিনগুলোতে দাম আরও বাড়তে পারে। তাদের দাবি, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে দর নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নেই। স্থানীয় বুলিয়ন মার্কেটে যারা ব্যবসা করেন, তারাই দর নির্ধারণ করেন। তবে দেশে দাম বাড়ার পেছনে অতিরিক্ত শুল্ককরও দায়ী বলে দাবি করেন গহনা ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি হওয়ার পেছনে সরকারের সরাসরি নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকা, নীতির দুর্বলতা, ডলারের উচ্চ দর এবং ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার লোভ অনেকাংশে দায়ী। তারা বলছেন, বাংলাদেশে স্বর্ণের দর নির্ধারণ করে মূলত বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। তারা যে প্রক্রিয়ায় দর নির্ধারণ করে, সেটি স্বচ্ছ নয়। তাছাড়া তাদের দর নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সরকারি তদারকি খুবই সীমিত। ফলে বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব, অবৈধ আমদানি এবং ভোক্তাদের তথ্যের অভাবের কারণে অনেক সময় অতিরিক্ত দাম গুনতে হয়। এ ছাড়া স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও দাম বাড়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হলো– বৈশ্বিক মূল্য, বৈদেশিক মুদ্রার হার, আমদানির খরচ ও যৌক্তিক মুনাফা বিবেচনায় নিয়ে একটি স্বীকৃত মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলা তৈরি করা যেতে পারে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যমতে, গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম প্রথমবারের মতো প্রতি আউন্স (৩১.১০ গ্রাম) চার হাজার ২০০ ডলার স্পর্শ করেছে, যা তিন বছর আগে অর্থাৎ, ২০২২ সালের শুরুতে ছিল দুই হাজার ডলারের কম।
দেশে দাম কত
বিশ্ববাজারে দর বাড়ার কারণে বাংলাদেশেও হুহু করে দাম বাড়ছে স্বর্ণের। দুয়েক দিন পরপরই দাম বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ছিল এক লাখ ৫৪৩ টাকা। বর্তমানে এই দর ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত দুই বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে দাম। এভাবে অন্যান্য মানের স্বর্ণের দাম বেড়ে বর্তমানে প্রতি ভরি ২১ ক্যারেট স্বর্ণের দাম দুই লাখ ৬ হাজার ৪৯৯ এবং ১৮ ক্যারেটের দাম এক লাখ ৭৩ হাজার এক টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম পৌঁছেছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৫১ টাকায়।
প্রতিবেশী দেশ এবং সৌদি আরবে দাম
বিশ্ববাজার এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ওয়েবসাইটের ১৫ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৩৪ দশমিক ৯৬ ডলার বা ১৬ হাজার ৪২৫ টাকা। একই সময়ে ভারতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণ প্রতি গ্রামের দাম ১৩৪ দশমিক ৭০ ডলার, পাকিস্তানে ১৩৬ দশমিক ৯৪ ডলার, নেপালে ১২৫ দশমিক ০৫ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৩১ দশমিক ১৪ ডলার, সৌদি আরবে ১২৬ দশমিক ৯১ ডলার এবং কাতারে ১২৭ দশমিক ৯৭ ডলার। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম অনেক বেশি। বর্তমানে দেশে ২২ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৫২ দশমিক ৩৯ ডলার বা ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা।
বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে দাম এত বেশি কেন জানতে চাইলে বাজুসের সহসভাপতি ও স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, বাজুসের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে দাম নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে আর কিছু জানেন না তিনি।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দেশে দর এত বেশি কেন– এমন প্রশ্নের জবাবে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র রায় বলেন, খুব বেশি ব্যবধান নেই। দেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ আসে। এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ীও আমদানি হয়। ব্যাগেজ রুলে আনলে ভরিতে পাঁচ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। ব্যাগেজ রুল ছাড়া আমদানি করলে আমদানি মূল্যের ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ভরিতে দুই হাজার টাকা শুল্ককর দিতে হয়। এসব কারণে দেশে স্বর্ণের দাম বেশি।
তিনি বলেন, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধ, ট্রাম্পের শুল্কনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের সুদ কমার কারণে ডলারের পতন ঘটছে। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের প্রতি আস্থা রাখছে না। ডলারের বদলে তারা স্বর্ণ কিনে মজুত রাখছে। এর চাপ পড়ছে স্বর্ণের বিশ্ববাজারে। ফলে হুহু করে দাম বাড়ছে। বিশ্ববাজারে বাড়লে সব দেশে বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কারণ স্বর্ণ আমদানি করতে হয়। বিক্রি কমেছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিক্রি তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে। তবে দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কম হলেও মুনাফা কমেনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বিশ্ববাজার ও প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি থাকার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কম দাম থাকলেও বাংলাদেশে রূপান্তরিত মূল্য অনেক বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নির্ধারিত আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য করের কারণে বৈধভাবে আমদানি করা স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। এ ছাড়া বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য, পরিবহন খরচ এবং কারিগরি খরচও দাম বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রাখে।
তাঁর মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত স্বর্ণের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা। দাম নির্ধারণে নির্দিষ্ট ফর্মুলা তৈরি করা। একই সঙ্গে অবৈধ আমদানি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, বাজার তদারকি জোরদার এবং ক্রেতাদের সচেতন করার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সমকাল