অর্থনৈতিক রিপোর্টার: দেশের শিল্পখাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ ও অগ্রগতির কথা জানিয়েছে জাপান-বাংলাদেশি ইথিক্যাল ফ্যাশন ও সাসটেইনেবিলিটি ভেঞ্চার রিভাইভাল গ্রুপ কো. লিমিটেড এবং রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড। তারা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেক্সিমকো টেক্সটাইল ডিভিশন লিজ নিয়ে পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে। এর ফলে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক আবার কাজে ফিরতে পারবেন, যা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকোমিলি, যা প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। শুরুতে তারা ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, একসময় দেশের টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল বেক্সিমকো টেক্সটাইল। তিন দশক সফলভাবে চলার পর ঋণসঙ্কটে পড়ে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ বন্ধের কারণে হাজারো শ্রমিক চাকরি হারায়, কারখানা-নির্ভর ছোট ব্যবসা ধসে পড়ে এবং আশেপাশের এলাকার অর্থনীতি অস্থির হয়ে পড়ে। রিভাইভালের এই উদ্যোগ সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন পথ তৈরি করছে; কারখানা আবার চালু হবে এবং কর্মীরা ফিরে পাবেন তাদের জীবিকার নিরাপত্তা।
রিভাইভাল জানায়, তারা কারখানাটি পূর্ণাঙ্গভাবে পুনরায় চালু করবে, পুরোনো ব্যবস্থাপনা দলকে ফিরিয়ে আনবে এবং আগের সব কর্মীকে পুনর্বহাল করবে। প্রতিষ্ঠানটির জাপানি–বাংলাদেশি পরিচয় এই পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারখানায় জাপানি ব্যবস্থাপনা এবং কার্যক্রমের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে জাপান থেকে অভিজ্ঞ শীর্ষ কর্মকর্তাদের আনা হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিকমানের জবাবদিহির জন্য একটি বৈশ্বিক বিগ ফোর অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হবে।
কারখানা চালুর পাশাপাশি রিভাইভাল বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে চায়। তারা বেক্সিমকোর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপন করবে এবং নতুন বৈশ্বিক অংশীদারও যুক্ত করবে। শুধু কম খরচে পোশাক উৎপাদন নয়, বরং বাংলাদেশকে সৃজনশীলতা ও ব্র্যান্ড উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। রিভাইভালের দর্শন— ‘স্থানীয় ডিজাইন, বৈশ্বিক বাজার’ (লোকালি ডিজাইন, সেল গ্লোবালি)-বাংলাদেশি পণ্যে নতুন উচ্চমান যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে।
এ লক্ষ্যে রিভাইভাল দেশে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট কোর্স এবং তরুণ ডিজাইনারদের জন্য প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা সেখানে পাঠদান করবেন, যা ভবিষ্যতের সৃজনশীল শিল্পে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করবে।
পুনরায় চালুর কাজ ইতোমধ্যেই এগিয়ে গেছে। রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড, বেক্সিমকো ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া গত ৮ অক্টোবর জমা দেওয়া হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভায় এটি পর্যালোচনা হবে এবং চলতি মাসেই চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। রিভাইভাল ও ইকোমিলির শীর্ষ কর্মকর্তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
রিভাইভালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা হুদা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ‘এটা শুধু কারখানা চালু করা নয়—হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রতিটি ফিরে আসা চাকরি নতুন করে আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।’
ইকোমিলির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস. করিম বলেন, ‘একজন প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুনরায় চালু করতে সহায়তা করতে পেরে আমি গর্বিত। এটি ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়—এটি ব্রেইন গেইনের গল্প। আমরা একসঙ্গে মানুষের জীবিকা ফেরানোর পাশাপাশি দেশের শিল্পখাতকে নতুন প্রাণ দিতে চাই।’
বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, “সরকারের নির্দেশে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের টেক্সটাইল বিভাগ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছে। ৪২ হাজার কর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি রক্ষা করা এবং প্রতি মাসে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ধরে রাখা ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর্থিক সংকটের মধ্যেও আমরা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো সচল রেখেছি যাতে যেকোনো মুহূর্তে কারখানা চালু করা যায়। রিভাইভালের উদ্যোগে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে।’
প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিলি ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে এবং প্রয়োজনে তা ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে উৎপাদন শুরু হলে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক আবার কাজে ফিরতে পারবেন। রিভাইভাল আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারবে, যা বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
জাপানের শৃঙ্খলা, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের দৃঢ় মনোবল মিলিয়ে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের পুনর্জাগরণ দেশের শিল্পখাতে নতুন দ্বার খুলে দেবে। কারখানার মেশিনগুলো আবার চালু হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর শ্রমিকরা অপেক্ষা করছেন কাজে ফেরার—এ যেন হাজারো পরিবারের জীবনে নতুন আশার সূচনা বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।