প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিয়েই জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে শর্ত শিথিলের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছিলেন। তা কার্যকর ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তখন যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাঠ প্রশাসনে দুই বছর কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় অনেক কর্মকর্তা ডিসি পদায়নের জন্য সাক্ষাৎকারও দিতে পারেননি। ফলে পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের ডিসি নিয়োগের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
তবে ডিসির ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটি শর্ত শিথিলের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১১ মাস চললেও শৈথিল্য বহাল রেখেছে। গত ২৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে রেজল্যুশনের মাধ্যমে শর্ত শিথিল বহাল রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে এখনও বিতর্ক চলছে।
শর্ত শিথিল করে পদায়নের কারণে মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা নেই এমন কয়েকজন কর্মকর্তা এবার জেলা প্রশাসক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিছু কর্মকর্তার রয়েছে নামমাত্র অভিজ্ঞতা। ফলে এসব ডিসির পক্ষে আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া, বিতর্কিত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ও আওয়ামী লীগের সুবিধা নেওয়া কর্মকর্তারাও ডিসির তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন।
এদিকে ডিসির পদায়ন নিয়ে নানা আলোচনার মুখে তড়িঘড়ি করে তাদের যোগদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ পটভূমিতে আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ৬৪ জেলার ডিসি ও ৮ বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসিদের উদ্দেশে নির্বাচন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
ডিসি পদায়নের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের ২৫, ২৭ ও ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা শিথিল করা হলেও ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তার বেলায় শৈথিল্য দেখানো হয়নি। আবার অর্থনীতি থেকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের ডিসি কার্যালয়, সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও, এডিসি, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, শুধু তাদের ডিসি করার কথা ছিল। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে তা আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, এরা কেউ সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়নি।
এদিকে সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও এবং এডিসি পদে কাজ না করে ডিসি নিয়োগ পেলে তারা মাঠ প্রশাসনে দক্ষতা দেখাতে পারবেন কিনা– এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিসি হতে হলে মাঠের কাজের ধরন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা বাঞ্ছনীয়।
যোগ দেওয়ার আগেই প্রত্যাহার ছয়জন
গত ৮, ৯ ও ১৩ নভেম্বর ৫২ জেলায় নতুন ডিসি দেওয়া হয়। এর মধ্যে নানা অভিযোগে ছয় কর্মকর্তাকে যোগ দেওয়ার আগেই প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন। এখন ৪৬ জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন আছে। এর মধ্যে অর্থনীতি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া ছয়জন ডিসি হয়েছেন। তাদের নির্বাচনী কাজে যুক্ত থাকার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। সব মিলিয়ে গত আড়াই মাসে নিয়োগ পাওয়া ১৬ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও মাঠের অভিজ্ঞতা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ আছে। নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা ৪৬ কর্মকর্তার মধ্যেও কয়েকজনের নামে নানা অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহে ডিসি পদে পদায়ন হওয়া আব্দুল্লাহ আল মাসউদ ও বরিশালের ডিসি খায়রুল আলম সুমনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং পাবনায় পদায়ন হওয়া শাহেদ মোস্তফা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শারমিন আক্তার জাহানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে। গাজীপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলম হোসেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রায় চার বছর।
এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জে সৈয়দা নুরমহল আশরাফী, নড়াইলে মোহাম্মদ আবদুল ছালাম, কুড়িগ্রামের অন্নপূর্ণা দেবনাথ ও পঞ্চগড়ের কাজী মো. সায়েমুজ্জামানকে ডিসি হিসেবে নিয়োগের শর্ত পূরণ হয়নি।
ডিসি নিয়োগে হিমশিম
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে বিতর্কিত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বাদ দিতে গিয়ে যোগ্য ডিসি খুঁজে পেতে বিপাকে পড়েছে সরকার। কারণ, ২৫ ও ২৯তম ব্যাচের ৪৭২ কর্মকর্তার মধ্যে প্রায় ৪০০ জন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সময় ইউএনও এবং এআরও ছিলেন। ফলে শর্ত শিথিল করার পরও ডিসি নিয়োগ করার মতো কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে ডিসি পদে পদায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বিভিন্ন পক্ষের দেনদরবার রয়েছে। সেখানে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত ও নতুন দল এনসিপির অনুসারীও আছেন। মূলত তিন পক্ষের চাওয়ার সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা। এজন্য গভীর রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হচ্ছে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ইউএনও-এডিসি না হলে ডিসি হিসেবে সঠিকভাবে কাজ করা কঠিন হতে পারে। কারণ, মাঠের কাজের ধরন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারীদের পদায়ন নীতিমালা, ২০২২-এ বলা হয়েছে, ডিসি ফিটলিস্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, এডিসি, জেলা পরিষদের সচিব, পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউএনও উভয় পদে ন্যূনতম দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, মাঠ প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারাই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন। তবে ডিসি হওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি, ভূমি প্রশাসন ও তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৮ ও ৯ নভেম্বর পর্যায়ক্রমে ১৫ ও ১৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করলে ‘রাতের ডিসি’ আখ্যা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়। কারণ, এ ধরনের প্রজ্ঞাপন গভীর রাতে জারির নজির খুব একটা নেই। এরপর বৃহস্পতিবার দুটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরও ২৩ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের কথা জানায় সরকার।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এহছানুল হকের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর দপ্তরে গেলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। samkal