সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন




শেখ হাসিনা: গণআন্দোলনের নেত্রী থেকে যেভাবে হয়ে ওঠেন স্বৈরাচার

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ ২:২৬ pm
Prime Minister Sheikh Hasina Wazed প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা Sheikh Hasina Prime Minister Bangladesh প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা Cabinet Secretary মন্ত্রিপরিষদ hasina pmhasina mp pm-hasina hasina hasina pm pm pm hasina pm sheikh hasina sheikh-hasina
file pic

ছাত্রজনতার গণ-আন্দোলনের মুখে চব্বিশের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন টানা ১৬ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা শেখ হাসিনা। অবস্থা বেগতিক দেখে সেদিন হাসিনা ও তার বোন রেহানা সামরিক হেলিকপ্টারে ওঠেন। দুপুর আড়াইটায় ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন তারা। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢেউ নামে ছাত্রজনতার। ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয়’ উদযাপন করেন সাধারণ মানুষ।

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। তার পিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়।

১৯৭৫ সালে তিন ছেলে, পুত্রবধূ ও স্ত্রীসহ সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর জার্মানি ও ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন শেখ হাসিনা। ১৯৯০-এ দেশে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হলে ১৯৯১-এর সাধারণ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কাছে তার দল অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায়।

পাঁচ বছর বিরোধী দলে থাকার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে হারিয়ে জয়ী হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০০ সালের নির্বাচনে তিনি ফের বিরোধীদলীয় নেত্রী হন। ২০০৬ সালে বিএনপির মেয়াদ শেষ হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হলে একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ সব উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে নতুন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর হাসিনা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করতে থাকেন। প্রথমেই বাতিল করেন তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা। শুরু করেন বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন। ক্ষমতাও দীর্ঘায়িত করার সব প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন তিনি। সে সময় তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে রাজপথে সোচ্চার হয় বিএনপি। সারাদেশে হরতাল-অবরোধসহ তীব্র আন্দোলনেও সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যায়নি বজ্রকঠিন শেখ হাসিনাকে।

এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। বাকি ১৪৭টিতে একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির প্রতিবাদে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। সে নিবার্চনে আওয়ামী লীগ ৩০০টির মধ্যে ২৩৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি দলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফের শপথগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপি মাঠেই দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও রাতে ব্যালটে সিল মারারও অভিযোগ ওঠে। প্রহসনের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ফের নিরঙ্কুশ জয় পায়। জাতীয় পার্টি ও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হয়। টানা চতুর্থবার ও পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনামলে দেশে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার বাড়ছিল। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। প্রথমে ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় শেখ হাসিনা ছাত্রদের এ অধিকার আন্দোলনকে দমন করতে সফল হলেও, একই দাবিতে চব্বিশের আন্দোলন মোকাবিলা করতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হন। চব্বিশের জুলাইয়ের প্রথমদিকে সংঘটিত ওই আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন হাসিনা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বংশধর’ বলে গাল দেন। পর্যায়ক্রমে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

একই বছরের ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরি থেকে কোটাব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি তুলে দেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে শত শত বিক্ষোভকারী প্রাণ হারান। দফায় দফায় আন্দোলন আরও তীব্র হতে থাকে। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে হাসিনাকে। একপর্যায়ে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন তিনি।

প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কেন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ালেন? জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মায়ুমি মুরায়ামা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাকে একজন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়নি।’ দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন বলে ইঙ্গিত দেন মায়ুমি।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তথাকথিত দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি করেন। তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুর্বল হয় বিএনপি। তবু কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও বিরোধীদের দমন করা থেকে এতটুকুও দমানো যায়নি তাকে। তিনি তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেবতাতুল্য’ করে তোলার চেষ্টা ত্বরান্বিত করেন এবং সরকারের সমালোচনা সহ্য করা যায় না, এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন।

দেশের মুসলিম নেতাদের প্রতি দমনপীড়নের মাত্রাও দিন দিন বাড়িয়ে দেন শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে দেশের প্রধান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দলীয় নিবন্ধন বাতিল করা হয়। হাসিনার শাসনামলে ভয়ে তটস্থ অনেকেই নীরব থাকলেও, যারাই আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন, তাদের জেল, জুলুম, গুম, নির্যাতন সহ্য করতে হতো। নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও ওয়ায়েজ। গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরও খড়্গহস্ত হন হাসিনা।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD