কলকাতায় মেট্রোরেল নির্মাণ শুরু হয় ১৯৭২ সালে, আর চালু হয় ১৯৮৪ সালে। কিন্তু ঢাকায় ২০১০ সালেও মেট্রোরেল ছিল স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। ঢাকা শহরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ২০০৪-২৪ এ প্রধান ছয়টি সুপারিশের পাঁচ নম্বরে ছিল তিনটি ম্যাস ট্রানজিট লাইন তৈরি করা। ২০০৯ সালে পরিকল্পনা অনুমোদন, ২০১২ সালে প্রকল্প অনুমোদন, ২০১৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু। আর কাজ শুরুর মাত্র ছয় বছরের মধ্যে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হলো।
মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনাটি ২০০৯ সালে অনুমোদিত হয়। পরে এটি সংশোধিত হয়ে আরএসটিপি ২০১৫-৩৫ নামে অভিহিত হয়। এখানে এমআরটি লাইন তিনটির পরিবর্তে পাঁচটি করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
প্রথম কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে এমআরটি লাইন ৬ উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করার সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো অপারেশন এজেন্সি থেকে এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটা হয়। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে মেট্রোরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন পায়।
সরকার মেট্রোরেলের পরিকল্পনা, সার্ভে, ডিজাইন, অর্থায়ন, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালের ৩ জুন ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠা করে।
২০১৬ সালের ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেলের লাইন-৬ (উত্তরা থেকে মতিঝিল) নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি স্টেশন ও ২৪টি ট্রেনের মাধ্যমে ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
ইতোমধ্যে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের শেষে উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। এ লাইনের আগারগাঁও থেকে কমলাপুর অংশ আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধন হতে পারে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যেই ছয়টি লাইনই দৃশ্যমান হবে। তিনি বলেন, আমাদের পরবর্তী লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট পরিবহন। পৃথিবী এগিয়ে চলছে, আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না। জাপান আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। আমরা আজকের বাংলাদেশকে উত্তরোত্তর পরিবহন খাতে, যোগাযোগ খাতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছি।
এমআরটি লাইন-৬ এর রুট অ্যালাইনমেন্ট
উত্তরা তৃতীয় পর্ব-পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড-বাংলাদেশ ব্যাংক-জসিম উদ্দিন রোডের প্রথম অংশ হয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের সামনে সার্কুলার রোড।
এর স্টেশনসমূহ হচ্ছে উত্তরা উত্তর-উত্তরা সেন্টার-উত্তরা দক্ষিণ-পল্লবী-মিরপুর ১০-মিরপুর ১১-কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া-আগারগাঁও-বিজয় সরণি-ফার্মগেইট-কারওয়ান বাজার-শাহবাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বাংলাদেশ সচিবালয়-মতিঝিল-কমলাপুর।
এমআরটি লাইন-১
বিমানবন্দর রুট: বিমানবন্দর-বিমানবন্দর টার্মিনাল ৩-খিলক্ষেত-নদ্দা-নতুন বাজার-উত্তর বাড্ডা-বাড্ডা-আফতাব নগর-রামপুরা-মালিবাগ-রাজারবাগ-কমলাপুর।
পূর্বাচল রুট: নতুন বাজার-নদ্দা-জোয়ার সাহারা-বোয়ালিয়া-মস্তুল-শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম-পূর্বাচল সেন্টার-পূর্বাচল পূর্ব-পূর্বাচল টার্মিনাল-পিতলগঞ্জ ডিপো।
২০২৬ সালের মধ্যে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উড়াল ও পাতাল মেট্রোরেলের সমন্বয়ে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ লাই-১ দুটি অংশে বিভক্ত। অংশ দুটি হলো– বিমানবন্দর রুট (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো)।
বিমানবন্দর রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার এবং মোট পাতাল স্টেশনের সংখ্যা ১২টি। বিমানবন্দর রুটেই বাংলাদেশে প্রথম পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মিত হতে যাচ্ছে। পূর্বাচল রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। এই রুটটি প্রধানত উড়াল এবং মোট স্টেশন সংখ্যা ৯টি। এরমধ্যে দুটি স্টেশন বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে পাতালে নির্মিত হবে।
উভয় রুটের যাচাই কাজ ও বেসিক ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিশদ নকশার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই লাইনের নির্মাণ কাজ ১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। ৩১ মে ২০২২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচটি প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতা আহ্বান করা হয়েছে। চারটি প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার দলিলপত্র জাইকা’র সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। অবশিষ্ট তিনটি প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার দলিল প্রস্তুত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ডিপোর ভূমি উন্নয়নের নিমিত্ত কারিগরিভাবে যোগ্য সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে দর কষাকষি শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনও সময় এমআরটি লাইন-১ বা বাংলাদেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে। লাইন-১ এর ডিপো ও ডিপো এক্সেস করিডোর নির্মাণের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ ও ব্রাহ্মণখালী মৌজায় ৯২ দশমিক ৯৭ একর ভূমির অধিগ্রহণ কার্যক্রম যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। সহসাই বাস্তব দখল বুঝে নেওয়া হবে।
লাইন-৫: উত্তর অংশ
এর রুট অ্যালাইনমেন্ট ও স্টেশনের অবস্থান; হেমায়েতপুর-বলিয়ারপুর-বিলামালিয়া-আমিনবাজার-গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-মিরপুর ১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুন বাজার-ভাটারা।
২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৪টি স্টেশন বিশিষ্ট মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও বেসিক ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিভিন্ন সার্ভে ও বিশদ নকশার কাজ চলছে। ডিপো ও ডিপো এক্সেস করিডোর নির্মাণের নিমিত্ত ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বিলামালিয়া ও কোন্ডা মৌজায় প্রথম পর্যায়ে ৯৯ দশমিক ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন ২০১৭ এর ৭ ধারার নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই রুটেই ঢাকার প্রথম পূর্ব-পশ্চিম এমআরটি করিডোর নির্মাণ করা হচ্ছে।
লাইন-৫ দক্ষিণাংশ
এ লাইনটির রুট অ্যালাইনমেন্ট ও স্টেশনের অবস্থান গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজ গেইট-আসাদ গেইট-রাসেল স্কয়ার-কারওয়ান বাজার-হাতিরঝিল-তেজগাঁও-আফতাব নগর-আফতাব নগর সেন্ট্রাল-আফতাব নগর পূর্ব-নাছিরাবাদ-দাশেরকান্দি।
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী হতে দাশেরকান্দি পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৫টি স্টেশন বিশিষ্ট মেট্রোরেল নির্মাণের নিমিত্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে সম্ভাব্যতা যাচাই, বিভিন্ন ধরনের সার্ভে ও প্রকৌশল নকশার কাজ চলমান রয়েছে।
এমআরটি লাইন-২ এর প্রস্তাবিত রুট অ্যালাইনমেন্টমেইন লাইন
গাবতলী-ঢাকা উদ্যান-মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড-ঝিগাতলা-সাইন্স ল্যাবরেটরি-নিউমার্কেট-আজিমপুর-পলাশী-ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ-গুলিস্তান-মতিঝিল-কমলাপুর-মান্ডা-দক্ষিণগাঁও-দামড়িপাড়া-সাইনবোর্ড-ভূইঘর-জালকুড়ি-নারায়ণগঞ্জ।
ব্রাঞ্চ লাইন: গোলাপ শাহ মাজার-নয়া বাজার-সদরঘাট
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে জি টু জি এর ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে লাইন-২ এর নির্মাণের লক্ষ্যে পিপিপি গবেষণা সম্পন্ন করে প্রিলিমিনারি স্টাডি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এমআরটি লাইন-৪
লাইন-৪ এর প্রস্তাবিত রুট অ্যালাইনমেন্ট কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া-সাইনবোর্ড-চট্টগ্রাম রোড-কাঁচপুর-মদনপুর। ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার মদনপুর পর্যন্ত লাইন-৪ নির্মাণের নিমিত্ত উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।