মেট্রোরেলকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার মুকুটে আরেকটি পালক বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের অহংকারের আরেকটি পালক সংযোজন করতে পারলাম। এটাই বড় কথা।’
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের ফলক উন্মোচনের পর বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে বেলা ১১টা ০৫ মিনিটে রাজধানীর উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ‘সি-১’ ব্লকের খেলার মাঠে মেট্রোরেলের উত্তর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। এরপর মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে যোগ দেন তারা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন ঢাকা মহানগরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে আজ মহানগরবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। মেট্রোরেল উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেট্রোরেলের উদ্বোধনের ফলে একইসঙ্গে প্রযুক্তিতে চারটি মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত, মেট্রোরেল নিজেই একটি মাইলফলক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রথম বৈদ্যুতিক যানের যুগে প্রবেশ করলো। তৃতীয়ত, মেট্রোরেল রিমোট কন্ট্রোল যান, যেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ধাপ। চতুর্থত, বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন যানের যুগে প্রবেশ করলো। মেট্রোরেল ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের উন্নয়ন যাত্রার সূচনা করেছিলেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।’
আগামী মাসেই বাংলাদেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি ইশতেহারে আমরা ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলাম। বর্তমান সরকার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ৬টি মেট্রোরেল লাইনের সমন্বয়ে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা-২০৩০ গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) আওতায় চারটি মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণ বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এবং দুটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য মেট্রোরেল, এই স্লোগানে ঢাকা মেট্রোরেলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো প্রয়োজনীয় সকল সুবিধাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত নিশ্চিতের জন্য প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে একটি স্বতন্ত্র নারী কোচ রাখা হয়েছে। প্রতি মেট্রো ট্রেনে নারীদের জন্য আলাদা বগি থাকবে, আলাদা ওয়াশরুম থাকবে। বাচ্চাদের পরিচর্যা করার সুযোগ থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মেট্রোরেলে পুরোপুরি ফ্রি চলাচল করতে পারবেন।’
মেট্রোরেল ব্যবহারে সবাইকে যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে মেট্রোরেল করা হয়েছে। এটা সংরক্ষণ করা, মান নিশ্চিত করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ব্যবহারকারীদের দায়িত্ব। ডিজিটাল ডিভাইস যেন নষ্ট না হয়, ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত্নবান হবেন। কেউ যেন আবর্জনা না ফেলে, খেয়াল রাখবেন।’
মেট্রোরেল চালুর ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে জানিয়ে তিনি বলেন,‘মেট্রোরেলের কারণে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবে। দৈনিক যাতায়াতের যে সময় নষ্ট হয়, টাকা-পয়সা নষ্ট হয়, তা আর হবে না। আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা হবে এই মেট্রোরেল। মেট্রোরেল পরিচালনায় চারগুণ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলবো। মেট্রোরেল পরিবেশবান্ধব। শব্দ ও কম্পন্ন দূষণমাত্রার অনেক নিচে থাকবে মেট্রোরেল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকা মহানগরবাসী ও অংশীজনের সর্বাত্মক সহযোগিতা ব্যতীত মেট্রোরেল নির্মাণ একটি দুরূহ কাজ ছিল। একটি সুন্দর মহানগরী বিনির্মাণে তাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ‘মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণকাজের সময় দুই পাশের বাসিন্দা, ব্যবসায়ীসহ জনগণকে খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, কষ্ট হয়েছে। এখন সেই কষ্ট শেষ। করোনার বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতিতেও নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন আওয়ামী লীগ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, টিম ডিএমটিসিএল, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একীভূত প্রচেষ্টার ফসল। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়োগান্তক ঘটনায় এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫-এ কর্মরত সাত জাপানি পরামর্শক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের স্মরণে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের যৌথ উদ্যোগে উত্তরা দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল প্রদর্শনী ও তথ্যকেন্দ্রে স্মৃতিস্মারক স্থাপন করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫: নর্দার্ন রুটের নতুন বাজার আন্তলাইন সংযোগ স্টেশনে স্থানান্তর করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেকোনও কাজ করতে গেলে সাহসের প্রয়োজন হয়। আওয়ামী লীগ সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। ১৪ বছরের মধ্যে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। ‘৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। আমরা ২১০০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা নিয়েছি। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের উন্নয়ন হয়, আজ এটা আবারও প্রমাণ হলো। এগিয়ে আমরা দুর্বার গতিতে যাবো।’
ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, ঢাকা-১৮ আসনের এমপি হাবীব হাসান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি, জাইকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইচিগুচি তমুহিদে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক প্রমুখ।
প্রথম যাত্রী হিসেবে মেট্রোরেলে চড়লেন প্রধানমন্ত্রী
দেশের ১৬ কোটি মানুষের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশনে বাটন টিপে ফলক উন্মোচন করে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোটবোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। এরপর মোনাজাতে অংশ নেন তারা। উদ্বোধনের পর উত্তরা সি ব্লকের খেলার মাঠে আয়োজিত সুধীসমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মারক ডাকটিকেট, প্রথম দিনের কভার ও স্মারক নোট উন্মোচন করবেন।
বেলা দেড়টার দিকে সুধী সমাবেশ থেকে দিয়াবাড়ি স্টেশনে আসেন প্রধানমন্ত্রী। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে এস্কেলেটর সিঁড়ি দিয়ে প্লাটফরমে আসেন তিনি। দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে সবুজ পতাকা ও হুইসেল বাজিয়ে মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্কেতের পর দিয়াবাড়ি স্টেশন ছেড়ে যায় মেট্রোরেলের প্রথম কোচটি। এরপর দুপুরপৌনে২টায় প্রথম যাত্রী হিসেবে মেট্রোরেলে চড়েন প্রধানমন্ত্রী।
দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে দিয়াবাড়ি স্টেশন ছেড়ে যায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী স্বপ্নের মেট্রোরেল। দুপুর ২টা ১১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী মেট্রোরেলটি আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছায়। মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোটবোন শেখ রেহানা, মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওদিকে মেট্রোরেল আজ উদ্বোধন হলেও সাধারণ যাত্রীরা আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে চড়তে পারবেন। প্রথম তিন মাস দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সরাসরি চলাচল করবে, মাঝের কোন স্টেশনে থামবে না। তিন মাস পর থেকে মাঝের স্টেশনগুলো থেকে সাধারণ মানুষ উঠতে পারবেন।