বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:১২ পূর্বাহ্ন




ফিলিস্তিনিদের রক্তবন্যা বন্ধ হবে কবে?

ফিলিস্তিনিদের রক্তবন্যা বন্ধ হবে কবে?

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:২৭ am
Israel Palestine Jerusalem Gaza Strip প্যালেস্টাইন ইসরায়েল ফিলিস্তিন উপত্যকা গাজা ভূখণ্ড শহর ইসরাইল
file pic

সংঘাত, অভিযান আর ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত সাংবাদিকদের একজনকে হত্যা-২০২২ সালে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনার অংশ।

জাতিসংঘ ২০০৬ সালের পর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর হিসেবে ২০২২ সালকে ঘোষণা করেছে। এই সময়ে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বলপ্রয়োগের প্রমাণ আর কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানের মাঝে রক্তবন্যা বয়ে গেছে ফিলিস্তিনে।

আবারও গাজায় সংঘাত

গাজা উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে ইসরায়েলি বোমা হামলার ১৫ মাসেরও কম সময় পর গত আগস্টের তিন দিন অবরুদ্ধ এই অঞ্চলে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান আক্রমণ চালায়। এতে ১৭ শিশুসহ কমপক্ষে ৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হন।

ইসরায়েলি বাহিনীর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) প্রধানকে গ্রেপ্তার উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করে। যার ফলে ইসরায়েল ও গাজা সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে ইসরায়েল।

গত ৫ আগস্ট গাজায় নতুন করে ব্যাপক পরিসরে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। এই হামলার পাল্টায় ইসরায়েলের ভেতরে রকেট নিক্ষেপ করে পিআইজে।

সেই সময় এই সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের দিকে যাবে বলে শঙ্কা ছিল— বিশেষ করে পিআইজের কমান্ডারদের হত্যার পর। কিন্তু মিসরীয় মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিন দিন পর সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যায়।

আর এই সংঘাত বৃদ্ধি না পাওয়ার প্রধান কারণ ছিল হামাস। গত ১৫ বছর ধরে গাজা শাসন করে আসা এই গোষ্ঠী লড়াই থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

গত বছরের ১১ দিনের সংঘাতের পর পুনর্নির্মাণের পথে হাঁটা গাজায় তারপরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতার হুমকি এখনও ফুরিয়ে যায়নি। গাজায় ফিলিস্তিনিরা ক্রমাগত ভীতিকর পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন। অনেকে ‘পরবর্তী যুদ্ধ অনিবার্য’ বলে মনে করছেন।

ফিলিস্তিনিদের ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র প্রতিরোধ

চলতি বছরে পশ্চিম তীরে বড় ধরনের যেসব পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, তার মধ্যে অন্যতম জেনিন এবং নাবলুসের উত্তরের শহরগুলোতে ছোট ছোট সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি।

২০২১ সালের জুনে জামিল আল-আমোরি নামের এক ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি সৈন্যদের হত্যার পর জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ‘জেনিন ব্রিগেড’ গঠিত হয়। পরে এই ধরনের অন্যান্য আরও কয়েকটি গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে।

জেনিন ব্রিগেডকে অনুসরণ করে ২০২২ সালে নাবলুস ব্রিগেড, লায়ন্স’ ডেন, বালাতা ব্রিগেড, তুবাস ব্রিগেড এবং ইয়াবাদ ব্রিগেড গঠন করা হয়। আর এসব গোষ্ঠী ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হলেও নির্দিষ্ট কোনও দল বা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে অস্বীকৃতি জানায়।

এই গোষ্ঠীগুলোর সক্ষমতা সীমিত হলেও তারা প্রায় প্রত্যেকদিনই অভিযানের জবাবে ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের দিকে মনোনিবেশ করে এবং ইসরায়েলি সামরিক তল্লাশি চৌকি লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ইসরায়েলি সৈন্য ও বসতি স্থাপনকারীকে হত্যা করা হয়েছে, এমন সব হামলারও দায় নেয় তারা।

ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (২০০০-২০০৫ সাল) পর এবারই প্রথম সংগঠিত এসব গোষ্ঠী পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে লড়াই করেছে। ওই ইন্তিফাদা বা বিদ্রোহের শেষে ভূখণ্ডের বেশিরভাগ অস্ত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) দখলে চলে আসে।

অভিযান আর হত্যা যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি

গত মার্চ মাসে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর একের পর এক হামলার পর ইসরায়েল ‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে। জেনিন এবং নাবলাসকে এই অভিযানের কেন্দ্র বানিয়ে পশ্চিম তীরে প্রায় প্রতিদিন অভিযান, গণগ্রেফতার এবং হত্যাযজ্ঞ চালায় ইসরায়েলি বাহিনী।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানে বেসামরিক ব্যক্তি এবং পথচারীরাও নিহত হন। লক্ষ্যকৃত গুপ্তহত্যা ও সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও মারা যান।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীর এবং দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ৩০ শিশুসহ কমপক্ষে ১৭০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আর আহত হয়েছেন আরও কমপেক্ষ ৯ হাজার মানুষ।

তবে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের মাঝে বিশেষ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। যার মধ্যে গত ১২ ডিসেম্বর জেনিনে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সেনা অভিযান দেখার সময় গুলি করে হত্যার ঘটনা ফিলিস্তিনিদের নাড়িয়ে দেয়। এছাড়া গত ২ ডিসেম্বর ২৩ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনিকে জনসমক্ষে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েলি সৈন্যরা। ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে নৃশংস ‘মৃত্যুদণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী এ বছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অত্যধিক প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। যে কারণে ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন তারা।

এর আগে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ইসরায়েলি বাহিনী ‘প্রায়ই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে’ বলে অভিযোগ তোলে।

শিরীন আবু আকলেহ হত্যাকাণ্ড

গত ১১ মে জেনিনের শরণার্থী শিবিরে অভিযানের সংবাদ সংগ্রহের সময় ইসরায়েলি বাহিনী আল জাজিরার প্রবীণ সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ৫১ বছর বয়সী আবু আকলেহ আল জাজিরা আরবির ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন।

২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সংবাদ কাভার করেছিলেন তিনি। তার হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

চলতি মাসে আল জাজিরা আবু আকলেহ হত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলা করেছে।

কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান

গত চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চলতি বছরে ইসরায়েলে পঞ্চমবারের মতো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে ইসরায়েলের ৭৪ বছরের ইতিহাসে কট্টর ডানপন্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জোট সরকার।

প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনীত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার লিকুদ পার্টি কট্টর ইহুদিবাদি এবং অতি-রক্ষণশীল অর্থোডক্স দলগুলোর সাথে জোট গঠন করেছে। এই জোটের মাধ্যমে ১২০ সদস্যের নেসেটে ৬৪ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তারা।

নির্বাচনের ফলাফলে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে ইহুদিবাদি জোট— যা বেজালেল স্মোট্রিচের নেতৃত্বাধীন ইহুদি পাওয়ার পার্টি ও ইতামার বেন-গভির নেতৃত্বাধীন একই নামের পার্টিকে এক মঞ্চে হাজির করেছে।

আর বিতর্কিত এই দুই রাজনীতিক ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বার বার সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার জন্য পরিচিত এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনে তাদের উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ্যেই বলে আসছেন।

গত বছর স্মোট্রিচ বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে ভুলবশত এসেছে— কারণ (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) বেন-গুরিয়ন তার কাজটি শেষ করে যেতে পারেনি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদেরকে ইসরায়েল থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।

এর আগে, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ‘ইসরায়েলের প্রতি অবিশ্বাসী’ বলে আখ্যায়িত করে নির্বাসনের আহ্বান জানিয়েছিলেন বেন-গভির। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সবসময় সাথে বন্দুক রাখারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য প্রায়ই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং সরকারের সমালোচনা করেন এই রাজনীতিক।

যাদেরকে পশ্চিম তীরে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলি সেই রাজনীতিবিদদের নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি— ইতোমধ্যে সেখানে চরম উত্তেজনায় রূপ নেওয়া পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণ বেড়েছে। চলতি বছর আরও বেপরোয়া ও সমন্বিত উপায়ে এই হামলা চালানো হয়েছে।

বেড়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হামলা

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণ বেড়েছে। চলতি বছর আরও বেপরোয়া ও সমন্বিত উপায়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। এ বছর বসতি স্থাপনকারীদের হাতে অন্তত তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নজরদারির সময় বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ওপর কয়েকবার হামলা চালায়।

গত ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এক বিবৃতিতে বলেন, বার বার বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণে ইসরায়েলি বাহিনীর সহায়তা, সমর্থন এবং অংশগ্রহণের বিরক্তিকর প্রমাণ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মাঝে পার্থক্য করাকে কঠিন করে তুলছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২২ সাল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলার সংখ্যা টানা বৃদ্ধি পাওয়ার ষষ্ঠ বছর।

‘সশস্ত্র এবং মুখোশধারী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে আক্রমণ করছে, স্কুলে যাওয়ার পথে শিশুদের আক্রমণ করছে, সম্পত্তি ধ্বংস করছে, জলপাই গাছ পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং ইসরায়েলের সরকারের দায়মুক্তির কল্যাণে সমগ্র সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করছে।’

পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্তত ২৫০টি অবৈধ বসতিতে বর্তমানে ৬ লাখ থেকে সাড়ে ৭ লাখ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী বসবাস করছে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD