আলোচিত ধারাবাহিক নাটক ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নিয়ে বিতর্ক চলছে নেট দুনিয়ায়। সমালোচনার মুখে নাটকটির চতুর্থ সিজনের কয়েকটি পর্ব ইউটিউব থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এর নির্মাতা কাজল আরেফিন অমি এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধ্রুব টিভি থেকেও ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
নাটকটির বিরুদ্ধে দর্শকের একাংশের অভিযোগ, এতে ‘আপত্তিকর’ সংলাপ এবং ‘অঙ্গভঙ্গি’ রয়েছে। যা দেশের সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে বেমানান। যদিও বরাবরই এই অভিযোগের বিপরীতে যুক্তি দিয়ে এসেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’কে ইঙ্গিত করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক। নাটকটির নাম উল্লেখ না করে তিনি এক প্রকার হুমকি দিয়েছেন এর নির্মাতা-শিল্পীদের। পোস্টে জুড়ে দিয়েছেন একটি কুড়ালের ছবি!
বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য বাংলা ট্রিবিউন যোগাযোগ করে টিভি নাটকের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসলে নাটকের মানুষ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যে ধারণা করে, সেটাকেই আমরা আবার পর্দায় তুলে ধরছি। মানুষ বলে, মিডিয়ার লোকজন খারাপ, মিডিয়ার লোকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না, তাদের কথা শুনলেই মনে করে চিটার। এমনিতেই নাটক অনেক দিন ধরে মুমূর্ষু জায়গায় ছিল। তার মধ্যে কতিপয় নামধারী পরিচালক ও শিল্পী আমাদের মূল নাটকের জায়গাটাকে নষ্ট করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে নাটক বানাচ্ছে।’
এ ধরনের নাটক দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সিদ্দিক। তার বক্তব্য, ‘মানুষ কিন্তু এ বিষয়ে সোচ্চার। তারা শিক্ষিত, পারিবারিক। তারা পরিবার নিয়ে নাটক দেখতে চায়। আমরা যখন নাটক করেছি বা করি, তখন মাথায় রাখি, আমার মা-বোন ড্রয়িং রুমে বসে দেখবে। কিন্তু এখন তো শিল্পীরও শেষ নেই, পরিচালকেরও শেষ নেই। যে কেউ এই পরিচয় দেয়। তারা এ ধরনের নাটক বানিয়ে আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সেই সঙ্গে মিডিয়ার মানুষদের ছোট করা হচ্ছে।’
আক্ষেপের সুরে সিদ্দিক আরও বলেন, ‘মিডিয়ার মানুষ হলো স্বপ্নের মতো, একসময় তারা বাইরে আদর্শ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু এই ধরনের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও পোশাক ব্যবহার করে তারা আদর্শ বা স্বপ্নের জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু তারাই যাচ্ছে না, যারা মূল শিল্পী তাদেরও দূরে নিচ্ছে। আমাকে হিট হতে হবে, তারা এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু তারা এটা চিন্তা করছে না, আমি যখন অভিনয় করবো, তখন দেশ, সার্বভৌমত্ব আমার সঙ্গে, দেশের পতাকা আমার সঙ্গে। আমি যেটা করবো, বাংলাদেশের পতাকার ওপর সেটার প্রভাব পড়বে।’
ফেসবুক পোস্টের ভাষা ও ছবি নিয়ে সিদ্দিকের মন্তব্য, ‘হতে পারে আমি হুমকিস্বরূপ বলেছি। কারণ, যারা এসব করছে, তারা মূল মিডিয়ার লোকজন না। মূল মিডিয়ার লোক হলে পোস্টে কুড়াল ব্যবহার করতাম না। তাদের আদরের সঙ্গে বলতাম। কিন্তু যেহেতু তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তাই এভাবে বলেছি।’
সোশাল মিডিয়ার যুগে সবাই যার যার মতো কাজ করতে পারেন। তবে মূল জায়গাকে নষ্ট করা যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিলেন এই অভিনেতা। বললেন, ‘ইউটিউব বা সোশাল মিডিয়া মুক্ত জায়গা। এখানে যে কেউ তার ইচ্ছেমতো জিনিস দিতে পারে। কিন্তু মূল জায়গাকে আঘাত করা যাবে না। সেটা তো আমরা হতে দেবো না। আমি সিদ্দিকুর রহমান যেহেতু নিজেকে নাট্যাঙ্গনের সদস্য মনে করি, তাই প্রতিবাদ করেছি। যদি এই দেশ ভালো না লাগে তাদের, এটাকে ইউরোপ-আমেরিকা বানাতে চান, তাহলে আপনারাই চলে যান। কারণ, এ দেশের মানুষ এখনও ড্রয়িং রুমে বসে নাটক দেখে, বাবা-মা পাশে থাকে। আমরা চাইবো, নাটকের ভেতরে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে, কিছু মজা থাকবে।’
এ বিষয়ে নাটক সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর দিকেও আঙুল তুলেছেন সিদ্দিক। তিনি বলেন, “আমাদের কিছু সংগঠন আছে, ভঙ্গুর সংগঠন আমি বলি। কারণ, যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারাও আশা করে ‘আমাকে এসব নাটকে ডাকে না কেন’! সংগঠনগুলোকে সরকারি পর্যায় থেকে বিলুপ্ত করা উচিত। এই ধরনের পরিচালক ও শিল্পীরা যাতে কোথাও কাজ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা নেবে সংগঠনগুলো। কিন্তু আমাদের সংগঠন নীরব।”
নিজেকে অভিনয়শিল্পী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ‘অভিনয়শিল্পী সংঘ আমি নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, আমার টাকা দিয়ে। যখন দেখলাম ওখানেও প্রচণ্ড রাজনীতি, তখন আমি চলে আসলাম। আমাদের আরেকটা সংগঠন আছে, সেটার বিরুদ্ধেও লিখবো, যেটার নাম এফটিপিও (ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন)। এসব সংগঠন শুধু নামে আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী কোনও সংগঠন আসা উচিত। ব্যক্তি সিদ্দিকের যদি ক্ষমতা থাকতো, একাই সংগঠন করে এগুলো দমাবে, তাহলে সেটাই করতাম।’
‘মাইক’, হাউজফুল’ কিংবা ‘চৌধুরী সাহেবের ফ্রি অফার’-এর মতো অসংখ্য নাটকে কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। যদিও তার অভিনীত চরিত্রগুলো নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। অনেক দর্শক-সমালোচক সে অভিনয়কে ‘ভাঁড়ামো’ বলেও অভিহিত করেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সিদ্দিক তার কাজের সংখ্যা ধারাবাহিক রাখতে পারেননি। সেটা কি দর্শক সমালোচনা বা চাহিদার অভাবে?
অভিনেতার জবাব, ‘আমি যখন বুঝতে পেরেছি, শিল্পী নামের কিছু অ-শিল্পী মিডিয়াতে ঢুকে গেছে, তাছাড়া এ দেশে শিল্পীর পেশাগত মর্যাদা নেই। যখন দেখলাম শেষ বয়সে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চেক নিতে হবে; তখনই চিন্তা করেছি মূল পেশা হিসেবে অভিনয়কে বেছে নেওয়া যাবে না। কারণ, আমি শেষ বয়সে ভিক্ষা করতে চাই না। আমরা আগে যেসব নাটক করেছি, সেগুলো দেখে মানুষ হাসতো, মজা পেতো; এখনও পায়। সেখান থেকে একটা পরিপূর্ণ মেসেজ পায়, ঘরের বাচ্চাটাকে কিছু শেখাতে পারে। যারা আমার দেশের সম্মান, সার্বভৌমত্বের মর্যাদা দিতে পারে না, তাদের সঙ্গে আমি কাজ করবো না। আমি মনে করি, এই মাঠে খেলার যোগ্যতা আমার নেই।’
তাহলে কি আপনি নতুন কোনও নাটকে কাজ করছেন না? উত্তরে সিদ্দিক বলেন, ‘আমার কিছু দর্শকের জন্য মাঝে মধ্যে করি। যারা বাংলা নাটককে ভালোবাসে, এখনও মনে করে, নাটকের মানুষ তাদের পরিবারের মতো; তাদের জন্য করি। আবার এই কাজ থেকে যে টাকা পাই, সেটা কিন্তু নিজে খাই না, গরিবের মাঝে দান করে দেই। আমার অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। তাতেই আমার চলে।’