কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশ- শুনে হয়তো অবাক হয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব! বাংলাদেশ ফুটবল দলের কাছে বিশ্বকাপ তো কল্পনারও বাইরে। তবে বাংলাদেশ দল না থাকলেও বিশ্বকাপের মঞ্চে আছে দেশের মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে অনুষ্ঠিতব্য ফিফা বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করবেন তারা। বাংলাদেশের অন্তত ৩০০ জন আছেন ফিফা বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। তাদের বেশিরভাগই প্রবাসী বাংলাদেশি। দেশটির পাঁচ শহরের ৮ স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের মোট ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। রবিবার (২০ নভেম্বর) থেকে শুরু হয়ে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বিশ্বকাপের এই উন্মাদনা।
স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ থেকেও পাড়ি জমিয়েছেন ছয় তরুণ। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সাক্ষী হতে অপেক্ষা করছেন উদ্বোধনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। কাতার বিশ্বকাপে আবেদন করা সাড়ে ৪ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে ২০-২১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে ১৬-১৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা। তারা কাতারে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন কিংবা কাজ করেন। কাতারের বাইরে থেকে ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়েছে ফিফা। তার মধ্যে বাংলাদেশের আছেন ৮ জন। এই আট জনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কাতারে গেছেন ছয়জন আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গেছেন দুজন।
কাতার বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হয়েছেন অন্তত ৩০০ বাংলাদেশি। তাদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থারনত প্রবাসী বাংলাদেশি। এর মধ্যে ছয় তরুণ আছেন যারা সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কাতারে গিয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে অংশ নিতে। তাদের মধ্যে একজন বেসরকারি নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফিন্যান্সে কর্মরত আলাওল আহমেদ রনি। তিনি পঞ্চমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনও আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
রনি বলেন, ফিফা বিশ্বকাপ আমার জীবনের পঞ্চম আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। আমি ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক গেমস থেকে আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে আসছি। তখন অলিম্পিক এবং প্যারা অলিম্পিকেও কাজ করেছি। এরপর রাশিয়ার উইন্টার অলিম্পিক, ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো অলিম্পিক, তাইওয়ানের আরেকটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে কাজ করার পর বিশ্বকাপের মঞ্চে আমি এই প্রথম।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে হলে ফিফার মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। আবেদন করার আগে একটা প্রোফাইল তৈরি করতে হয়। ফিফার বিভিন্ন আয়োজনের আগে তারা আমন্ত্রণ জানায়। তখন সেসব ইভেন্টে আবেদন করতে হয়। আবেদনে পর ফিফা স্ক্রিনিং করে। অনেককে বাদ দেওয়া হয়। এরপর মনস্তাত্ত্বিক একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষা অনেক জায়গায় নেওয়া হয় আবার অনেক ক্ষেত্রেই নেওয়া হয় না। কাতার বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার পর আমাদের এই ছয় জনের একটি দলগত ইন্টারভিউ নেওয়া হয়।
ঢাকার একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করা রেজাউল হোসেন অনিক দ্বিতীয়বারের মতো ফিফা বিশ্বকাপের মঞ্চে যুক্ত হয়েছেন। তিনি এর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপেও স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করার জন্য বেতনবিহীন ছুটি নিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
অনিক বলেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে আমি একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নির্বাচিত হই। মারকানা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে আমি কাজ করেছি। কাতার বিশ্বকাপে যেখানে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে সেই লুসায়েল স্টেডিয়ামে আমি দায়িত্ব পালন করবো। আমি এখানে কাজ করার জন্য কোম্পানি থেকে দুমাসের ছুটি নিয়েছি। তবে কোম্পানির নীতিমালা অনুযায়ী বেতনভুক্ত ছুটি আমাকে দিতে পারিনি। তাই বেতন ছাড়াই ছুটি নিয়ে আসছি। ছুটি পেয়েছি, এতেই আমি ধন্য।
ওয়াসিফ আজাদও দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে যুক্ত হয়েছেন। তিনি ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করেছেন। রনি এবং আজাদ আল বায়াত স্টেডিয়ামে দায়িত্ব পালন করবেন যেখানে হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আর অনিক কাজ করবেন কাতারের বিখ্যাত লুয়াসেল স্টেডিয়ামে।
হাসান একটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেবেন জেনে তার প্রতিষ্ঠান ছুটি মঞ্জুর করেছে। তিনি প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। আল জানুব স্টেডিয়ামে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
পিয়াল রিজওয়ান একটি গ্রুপ অব কোম্পানির বিপণন বিভাগে রংপুরে কাজ করেন। অনিকের মতো পিয়ালও বেতন ছাড়া ছুটি ভোগ করছেন শুধু কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য। পিয়াল ও রনি একসঙ্গে ব্রাজিল অলিম্পিকে কাজ করেছেন। পিয়াল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে।
পিয়াল বলেন, আমি দুমাসের জন্য ননপেইড লিভ নিয়ে কাতারে এসেছি। আল বায়াতে আমি কাজ করবো স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তৌহিদ কাজী বর্তমানে কাতারে অবস্থান করছেন। স্নাতকের শেষ সেমিস্টার ফেলে চলে গেছেন কাতার। প্রথমবারের মতো কোনও আন্তর্জাতিক ইভেন্টে যুক্ত হয়েছেন তিনি। তৌহিদ কাজ করবেন ফিফা ফ্যান ফেস্টে। যাদের কাছে খেলা দেখার টিকিট নেই তাদের জন্য এই ফ্যান ফেস্ট হিসেবে আলাদা এলাকা তৈরি করেছে কাতার সরকার। সেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আব্দুল করিম সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে একটি রেস্তোরাঁতে কাজ করতেন। বিশ্বকাপে আসার জন্য তার কোম্পানি থেকে চাকরি ছেড়ে আসতে হয়েছে। কোম্পানির কাছ থেকে ছুটি চেয়ে তিনি পাননি, তাই সেই চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন কাতার। এর বাইরে মোহাম্মদ শহীদ হোসেন আছেন যিনি টিম লিডার হিসেবে কাজ করবেন। তিনি আট বছর ধরে কাতারে বসবাস করেন।
শহীদ বলেন, আমি একটি আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁয় ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলাম। গত পাঁচ মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। ফিফায় কাজ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমি রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে জানাই যে আমি ফিফায় কাজ করবো কিন্তু আমাকে কোন ছুটি দিতে রাজি হয়নি, তাই ছেড়ে দিয়েছি।
এছাড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে আছেন আবরার মোহাম্মদ সাকিব। তিনি দুবাইতে বসবাস করতেন। সেখানে ২২ বছর কাজ করেন। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক কোনও ইভেন্টে প্রথমবারের মতো কাজ করছেন তিনি।
সাকিব বলেন, এখানে পরিবেশ অনেক ভালো। অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে দেখা হচ্ছে। অনেক ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে এটি একটি বড় অভিজ্ঞতা। এমন বড় বড় আয়োজন থেকে নিজেকেও অনেকভাবে তৈরি করা যায়।
কাতার বিশ্বকাপে বাংলাদেশি এসব তরুণদের যোগদান দেখে তাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কাতারের বাংলাদেশি ফ্রেন্ডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল হোসেন রনি। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে যোগদান করায় তাদের এই অভ্যর্থনার আয়োজন করেন তিনি।