১১ই জুন ১৯৮৬। মেক্সিকোর জাপোপানের স্টেডিয়ামে পর্তুগালের মুখোমুখি মরক্কো। সেদিন পর্তুগিজদের ৩-১ গোলে উড়িয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয়টি পেয়েছিল মরক্কো। ১০ই ডিসেম্বর ২০২২। দোহার আল থুমামা স্টেডিয়ামে সেই পর্তুগালকেই ১-০তে হারিয়ে নতুন ইতিহাস গড়লো মরক্কো।
প্রথম আফ্রিকান ও আরব দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠলো তারা। আর অশ্রুসিক্ত নয়নে মাঠ ছাড়লেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারের বিশ্বকাপ ট্রফির স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। ‘অ্যাটলাস লায়ন’ খ্যাত মরক্কোর হয়ে ঐতিহাসিক গোলটি করেন ইউসুফ আন-নাসেরি। বৃটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল বলেছে চলতি আসরে এটাই সবচেয়ে বড় অঘটন।
পারফরম্যান্স বিচারে মরক্কোর জয়কে অঘটন বলা যায় কি? গ্রুপপর্বে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ড্র আর বেলজিয়ামকে হারিয়ে সেরা দল হিসেবে শেষ ষোলোতে পা রাখে মরক্কো। সেখানে সাবেক চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে আসে কোয়ার্টার ফাইনালে। গতকাল পর্তুগালের চেয়ে বল পজেশনে (মাত্র ২৬%) অনেক পিছিয়ে থাকলেও বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করেন আশরাফ হাকিমি-হাকিম জিয়াশরাই। ব্যবধানটা ১-০ না হয়ে আরও বেশি হতে পারতো।
ম্যাচের পর বিবিসি রেডিও ফাইভকে মরক্কোর মিডফিল্ডার সুফিয়ান আমরাবাত বলছিলেন, ‘এই জয় আমাদের প্রাপ্য। ১০০০%। জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছি। দেশের মানুষের জন্য সবটুকু নিংড়ে দিয়ে খেলেছি। ইনজুরি ছিল। তিনজন নতুন ডিফেন্ডার মাঠে নেমে যেভাবে আটকে রাখলো ওদের। সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কোচ, স্টাফ, সতীর্থ সবার প্রতি শ্রদ্ধা। ধন্যবাদ জানাই তাদের, যারা মাঠে এসে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। মনে হচ্ছিল, ঘরের মাঠে খেলছি।’ ঘরেই খেলেছে মরক্কো। বিপুল সমর্থন পেয়েছে দলটি। গ্যালারিতে পরিবারের সদস্যরাও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। পিএসজি তারকা আশরাফ হাকিমির মা প্রতিটি ম্যাচেই উপস্থিত ছিলেন। গতকাল সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর হাকিমি ছুটে যান মায়ের কাছে। আল থুমামার গ্যালারিতে অবতারণা হয় এক অভাবনীয় দৃশ্যের।
আল থুমামা স্টেডিয়ামে ৪২তম মিনিটে লিড নেয় মরক্কো। ইয়াহিয়া আতিয়াতুল্লাহর ক্রস থেকে হেডে পর্তুগালের জালে বল পাঠান ইউসুফ আন-নাসেরি। এই গোলের সুবাদে মরক্কোর হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি (৩) গোল করার রেকর্ড গড়েছেন নাসেরি। ৪৫তম মিনিটে ব্রুনো ফার্নান্দেজের প্রচেষ্টা বারে প্রতিহত না হলে সমতায় ফিরতে পারতো পর্তুগাল।
প্রথমার্ধে ৭টি শট নেয় পর্তুগাল। দুটি ছিল লক্ষ্যে। অন্যদিকে মরক্কো ৫ শটের একটি লক্ষ্যে রাখে। সেখান থেকেই গোল। ৫১তম মিনেট রুবেন নেভেসের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন রোনালদো। তবে মরক্কোর রক্ষণ কোনোভাবেই ভাঙতে পারছিল না পর্তুগাল। ৮৪তম মিনিটে জোয়াও ফেলিক্সের বুলেট গতির শট ঠেকিয়ে দেন মরক্কোর গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনু। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হয় মরক্কোর ১-০ গোলের লিডে।
যোগকরা সময়ে প্রথম মিনিটে (৯০+১ মিনিট) রোনালদোর নিচু শট আটকে দেন বুনু। দুই মিনিট পর দ্বিতীয় হলুদ কার্ড (লাল কার্ড) দেখে মাঠ ছাড়েন মরক্কোর ওয়ালিদ শেদিরা। ৯৬তম মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল মরক্কো। কিন্তু গোলরক্ষককে একা পেয়েও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি আবুলখালাল। পরের মিনিটে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে পেপের নেওয়া হেড লক্ষভ্রষ্ট হয়। এরই সঙ্গে পর্তুগালের হারও নিশ্চিত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বিশ্বকাপে প্রথমার্ধে পিছিয়ে পড়ে ১৯৬৬ সালের পর কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি পর্তুগাল (৭ হার)।
শেষ বাঁজি বাজার পর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগিকে মাথায় তুলে আনন্দে মেতে ওঠেন মরক্কোর ফুটবলাররা। তাদের এই অভাবনীয় সাফল্যে কোচের অবদান স্বীকার না করলেই নয়। বিশ্বকাপ শুরুর মাস তিনেক আগে দায়িত্ব পান রেগরাগি। অল্প দিনের মধ্যে দলে একতা ফিরিয়ে আনেন তিনি। ফিরিয়ে আনেন আক্রমণভাগের সেরা তারকা হাকিম জিয়াশকে। আগের কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলকেই বিদায় বলে দিয়েছিলেন চেলসি তারকা জিয়াশ। সেই জিয়াশ এখন ইতিহাসের পাতায়। রেগরাগির অধীনে ৮ ম্যাচে অপরাজিত মরক্কো। বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি গোল হজম করেছে দলটি। কানাডার বিপক্ষে হজম করা গোলটিও ছিল আত্মঘাতী। এই মরক্কো যদি ফাইনালে চলে যায় অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হাকিমিদের জয়োৎসবের পর গ্যারি লিনেকারের টুইট, ‘ফুটবল ইজ গ্রেট, দ্য ভেরি বেস্ট।’ লিনেকার যথার্থ বলেছেন। হাকিমি-জিয়াশরা তো ফুটবলেরই জয়গান গেয়ে চলেছেন।