সরকারের পদত্যাগসহ অভিন্ন দাবিতে সমমনাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। শনিবার ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এই সমাবেশের আগেই যুগপৎ আন্দোলনকে সামনে রেখে সমন্বয় কমিটি গঠন ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার কথা ছিল। কিন্তু সমাবেশের একদিন আগে নয়াপল্টনে সংঘর্ষ ও ধরপাকড়ের কারণে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। সমাবেশের দিন বিএনপি যে ১০ দফা দাবি পেশ করেছে সমমনা দলগুলোর অনেকে তার প্রতি সমর্থন দিয়ে সামনের কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। প্রকাশ্যে আলোচনায় না থাকলেও বিএনপি’র এক সময়ের জোট শরিক জামায়াত বিএনপি’র সঙ্গে সমন্বয় রেখে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আসছে ২৪শে ডিসেম্বর বিএনপি’র গণমিছিলের দিন জামায়াতও একই কর্মসূচি দিয়েছে। এ ছাড়া ২০ দলের শরিক ১১টি দল বিএনপি’র দাবি ও কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। কর্নেল অব. অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমক্রেটিক পার্টি এলডিপি’র পক্ষ থেকে গতকাল বিএনপি’র ১০ দফা ও যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচিতে সমর্থন জানানো হয়েছে। এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলন করতে আগে থেকে আলোচনা চালিয়ে আসা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি যে ১০ দফা ঘোষণা করেছে এর সঙ্গে মিল রেখেই অন্য দলগুলোও নিজেদের দাবিনামা পেশ করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ আলাদাভাবে ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যুগপৎ আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটি গঠন হলে এটি ১০ দফার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। নেতারা জানান, শিগগিরই বিএনপি’র সঙ্গে অন্যান্য দলের বৈঠক হবে। বৈঠকে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণ ও সমন্বয় করা হবে। কমিটি গঠনের পর অভিন্ন দাবিতে দলগুলো আলাদা কর্মসূচি পালন করবে। প্রয়োজনে একসঙ্গেও কর্মসূচি আসতে পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সেরে রেখেছেন নেতারা। ছাত্রঐক্য গঠনের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে।
২০ দলীয় নেতারা জানান, যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বিএনপি তার শরিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার সংলাপ করেছে। সংলাপ থেকে আন্দোনের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা উঠে এসেছে। বিএনপি’র সর্বশেষ ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের আন্দোলনের শেষ হয়েছে বলে নেতারা মনে করছেন। তারা জানান, ২৪শে ডিসেম্বরের গণমিছিল থেকে দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সরকার পতন আন্দোলনে বিএনপি’র ১০ দফা দাবির সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করেছি। বিএনপি’র সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপের পর এই দাবিগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী ২৪শে ডিসেম্বর আমরা একত্রে গণমিছিলে অংশ নেবো। এর মাধ্যমে সরকার পতন আন্দোলন আরও জোরদার হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে ছিলাম, আছি। একসঙ্গেই যুগপৎ আন্দোলনে যাবো। সেখানে কীভাবে যুগপৎ আন্দোলন বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে যুগপৎ আন্দোলন, ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসন ব্যবস্থা বদলের লক্ষ্যে ১৪ দফা প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। সেখানে সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি, সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, গুম-খুনের বিচার ও তদন্ত কমিটি গঠন, যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের তদন্ত, গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, স্বাস্থ্য সম্পদ বিবেচনা করা, কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ প্রভৃতি তুলে ধরা হয়েছে। বিএনপি যে ১০ দফা ঘোষণা করেছে তার সঙ্গে আমাদের অনেকগুলো দাবির মিল রয়েছে। আমরা শুধু সরকার পরিবর্তনই চাই না, সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনও চাই। বিএনপি’র সঙ্গে কীভাবে যুগপৎ আন্দোলনে যাবো, এ নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে। তারপর চূড়ান্ত আন্দোলন।
ওদিকে মঞ্চের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে নেতারা বৈঠক করেছেন। এতে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানাবে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, বিএনপি’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিকল্প নেই। বিএনপি যেভাবে নির্দেশ দেবে, সেভাবেই বাস্তবায়ন করবো। যুগপৎ আন্দোলন শুরুর আগে একটি লিয়াজোঁ কমিটি হবে। ২৪শে ডিসেম্বর এই আন্দোলনের সূচনা হবে। এদিকে, শনিবার বিএনপি’র নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২০ দলীয় জোটের ১১টি দল গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে বিএনপি ঘোষিত ১০ দফাকে সমর্থন করে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা।
একইসঙ্গে দাবি আদায়ে ২৪শে ডিসেম্বরের বিএনপি ঘোষিত গণমিছিলে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করবে দেশের ১১টি রাজনৈতিক দল। গণমিছিলে বিএনপির সঙ্গে যৌথভাবে অংশ নেয়ার কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপা’র সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, বাংলাদেশ এলডিপি’র মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, ইসলামী ঐক্য জোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব, এনডিপি চেয়ারম্যান আবু তাহের, ন্যাপ-ভাসানীর চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম, মুসলিম লীগ মহাসচিব শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, জমিয়তে (একাংশ)’র মহাসচিব মহিউদ্দিন ইকরাম ও সাম্যবাদী দল (একাংশ)’র সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
এদিকে বিএনপি বিগত মাসগুলোতে সমমনা ৩৫ দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য ধারাবাহিক মতবিনিময় করে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য বৈঠক হয়নি। এতদিন জোটে নেই-জানানো হলেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন দাবিতে একইদিনে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। শনিবার ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। একইসঙ্গে জামায়াতও ১০ দফা ঘোষণা করে। দুই দলের দাবিসমূহ প্রায় একই। সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৪শে ডিসেম্বর সারা দেশে গণমিছিল করবে বিএনপি।
অন্যদিকে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী যুগপৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। আগামী ২৪শে ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহর ও জেলায় জেলায় গণমিছিল করবে দলটি।
১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে জামায়াতের আমীর বলেন, দেশকে আজ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় হলো জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই জন্যই প্রয়োজন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এরই প্রেক্ষিতে আমরা যুগপৎভাবে গণআন্দেলন গড়ে তোলার জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করছি। [মানবজমিন]