বাংলাদেশে সম্প্রতি বেশ কিছু দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল যে, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নতুন কোন নিষেধাজ্ঞা কিংবা অন্যকোন পদক্ষেপ আসতে যাচ্ছে কি না। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা এসেছে আমেরিকার পক্ষ থেকে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বুধবার এক ঘোষণায় বলেন, যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়- তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। এর আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা।
এমন ঘোষণার পর আওয়ামীলীগ বলছে যে, আমেরিকার মতো তারা দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চান। তাই এটা তাদের জন্য কোন সমস্যা নয়। তবে বিরোধীদল বিএনপি বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত হওয়ার কারণে এই ঘোষণা তাদের জন্য এক প্রকার চাপ। তবে যদিও ভিসা নীতির ঘোষণায় সরকার বা কোন পক্ষের নাম সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তাদেরও চাওয়া। আর এর জন্য তারা নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।
তিনি বলেন, “একটা কথা আমরা বারবার বলে আসছি যে, আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করবো এবং একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে আমরা সব ধরণের সহযোগিতা করবো।” “আমরা নির্বাচন চাই। আমাদেরও এটা কথা, এই নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তাদেরকে আমরা অবশ্যই প্রতিহত করবো।”
সেতুমন্ত্রী বলেন, “আমার এখানে সর্বশেষ কথা, বেশি গৌরচন্ডিকা না করে, আমি বলতে চাই, যারা আন্দোলনে নামে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বাসে আগুন দেয়, ভাঙচুর করে, এরাই একটা পলিটিক্যাল ভায়োলেন্সে আছে। কাজেই ওদের খবর আছে।”
বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, নতুন ভিসা নীতি নিয়ে আমেরিকা যে ঘোষণা দিয়েছে সেটি নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সরকার চিন্তিত নয়। “আমাদের এনিয়ে কোন ভয় নাই। স্যাংশন কারো উপর তো দেয় নাই। ইন্ডিভিজুয়ালের উপর দেবে, কেউ যদি করে।”
“আমাদের অবস্থান খুবই সুস্পষ্ট। কোন অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেটা সঠিক না সেটা করবো না।এমন কিছু করবো না যাতে আমাদের কেউ তাদের ভিসা থেকে বঞ্চিত হয়,” বলেন কৃষিমন্ত্রী।
মি. রাজ্জাক বিষয়টিকে শুধু সরকারের প্রতি বার্তা হিসেবে দেখছেন না।। তিনি মনে করেন এখানে বিরোধী দলের জন্যও বার্তা রয়েছে। এটা সবার জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করলে যুক্তরাষ্ট্র সেটা সমর্থন করেনা। “আমরাও বারবার বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তিনি যে কোন মূল্যে একটি সুন্দর-সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন।”
“কেউ যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাদের দায়িত্ব। তবে আমরা শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা করবো সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য।এ ব্যাপারে সরকারের কোন কার্পণ্য থাকবে না, কোন রকম আন্তরিকতার অভাব দেখাবে না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমেরিকার ভিসা নীতির ঘোষণার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন যে তারা এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে অন্তত এ ধরণের একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশে আগামী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
“আমরা তো ওয়েলকাম করছি। যারা ভোট চুরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত, বিএনপি তো ভোট চুরির প্রক্রিয়ায় নাই, তারা (আওয়ামী লীগ) উদ্বিগ্ন না থাকলে তো ভাল কথা,” বলেন খসরু। “এইটার মাধ্যমে যে সব কিছু হবে তা না, তবে এইটা একটা সিগনাল, একটা মেসেজ যে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারছে না। বাংলাদেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে।”
এদিকে ভিসার কড়াকড়ি নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মতামত জানতে চাইলে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই বিবৃতিটি দেখেছেন তারা। তবে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত কোন মত দিতে চাননি তিনি। মি. হোসেন বলেন, এটা আমরা দলে আলোচনা করবো। পরে এটা আমরা কিভাবে দেখছি সেটা প্রকাশ করবো।
তিনি বলেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে আমেরিকার এই ভিসা নীতি নিয়ে তারা কবে বক্তব্য দিতে পারবেন তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়। এটি নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করবেন না বলেও জানান।
তিনি বলেন, “এই বিষয়গুলো আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন করা। এ জন্য যা যা দরকার আমরা তা করবো।”
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এই ভিসা নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দুটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। প্রথমত, যারা ইতিবাচকভাবে বা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে তাদের এই ভিসা নীতিতে চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই।
দ্বিতীয়ত, যারা এই প্রক্রিয়াকে যেকোনভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে, ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির মতো কাজ দিয়ে, তারা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা ভিসার জন্য বিবেচিত হবেন না। এর মাধ্যমে তারা যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক গতিতে চলার জন্য যদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাহলে তিনি যেই হোন না কেন, তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থান থাকবে।
এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই – এমন মন্তব্য করে সাবেক এই কুটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে যেমন এই বিষয়টা নিয়ে কথা হচ্ছে তেমনি বাংলাদেশের বন্ধু বা সহযোগী যারা আছেন তারাও এই ব্যাপারটাতে বেশ চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কিছুদিন যাবত। প্রায় সকলেই এটা নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। জাতিসংঘও গত পরশু এটা তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, “এই বিষয়টা নিয়ে সবার মধ্যেই স্বাচ্ছন্দহীনতা ও উৎকণ্ঠা আছে সেটা তো আমরা বুঝতেই পারছি।”
যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ ইতিবাচকভাবে নেয়া হলে তা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। আর সেটা না মানলে দেশের ভিতরে যেমন সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যায়, সেই সাথে আন্তর্জাতিকভাবে গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সেটাও হুমকীর মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, “প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। সবারই কমবেশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আছে। তাই আমেরিকাকে গুরুত্ব না দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই যারাই নির্বাচনের সাথে যারাই সংশ্লিষ্ট থাকবেন তারাই এটাকে গুরুত্ব দেবেন বলে মনে করেন তিনি।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন যে, আমেরিকা যে বক্ব্য দিয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী যেটা চাচ্ছেন সেটাকেই আরো জোড়ালো ভাবে বলেছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা বরং আমাদের অবস্থানকে একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে।
“আমরা আমাদের যেটা ভাল, স্বচ্ছ, সুন্দর ইলেকশন করার আমরা করে যাবো।এটা আমাদের জন্য বাড়তি প্রেশার না, তারা তাদের কাজ করেছে, আমরা আমাদের কাজ করে যাবো।”
তিনি বলেন, “২০০৮ সাল থেকেই গণতান্ত্রিক মাধ্যমেই সরকার পরিচালনা করেছে। আর এর আগে যারা ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়লাভ করেছে তাদের এদেশের মানুষ গদিতে রাখেনি। তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।”
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একেবারে বদ্ধ পরিকর জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এমন নির্বাচন করার জন্য যত ধরণের প্রক্রিয়া প্রয়োজন তার সবই করছে। “কেউ কেউ অভিযোগ করে যে, রাতের অন্ধকারে নাকি ভোট হয়ে যায়। এজন্য আমরা স্বচ্ছ, ট্রান্সপারেন্ট ব্যালট বাক্স তৈরি করেছি।”
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেখানে কোন ধরণের হত্যাযজ্ঞ হবে না- এমন নির্বাচন চাইলে সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, এনজিও সবার সহযোগিতা দরকার বলেও উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আমেরিকার নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। সে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভিসা কড়াকড়ির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তার বিষয়ে অবগত আছে বাংলাদেশ সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর টেকসই অঙ্গীকারের পাশে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়াকে সরকার সমর্থন করছে।
সে বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের উন্নয়ণমূলক কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়। সেখানে আরো বলা হয়, জনগনের ম্যান্ডেট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার কোন নজির নেই।
“বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকারের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। ভোট কারচুপির মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট কেড়ে নিয়ে কোনো সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার নজির নেই।”
এই ঘোষণাকে সরকার দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে সব স্তরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকারের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার হয়েছে। এবং এর আওতায় ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি এবং স্বচ্ছ্ব ব্যালট বাক্স প্রবতৃন করা হয়েছে।
বিএনপি সরকারের সমালোচনা করে সেখানে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক এক কোটি দুই লাখ ৩০ লাখ ভূয়া ভোটারের তালিকার বিপরীতে ফটো-ভিত্তিক ভোটার আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়েছিল।
সরকার সব শান্তিপূর্ণ ও বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সমাবেশ ও সমিতির স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়। সরকার আশা করে যে, স্থানীয় অগণতান্ত্রিক শক্তি যারা সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা সতর্ক থাকবে।