বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন




চলমান একীভূতকরণ প্রক্রিয়া

ব্যাংক খাতে আতঙ্ক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

আউটলুকবাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:২৭ am
Mobile Banking মোবাইল ব্যাংকিং Bangladesh Bank Explore banking services credit cards loans financial business Guarantee Finance Investment Commerce INTER BANK ‎বাংলাদেশ ব্যাংক ‎বাণিজ্যিক ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং ‎এজেন্ট ব্যাংকিং
file pic

এখন ব্যাংক খাতে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কখন কোন ব্যাংককে কার সঙ্গে একীভূত করে দেবে তা কেউ জানে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আপাতত পাঁচ ব্যাংকের বাইরে আর কোনো ব্যাংক একীভূত করা হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকারদের পাশাপাশি আমানতকারীদের মধ্যেও নানা রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কেউ কেউ ভয়ে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

এদিকে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একত্রিত হতে আপত্তি জানিয়েছে সরকারি বেসিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মানববন্ধন করেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও। বুধবার বিকালে বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ সভা ছিল। সেখানেও কোনো বেসরকারি ব্যাংকের অধীনে বেসিক ব্যাংক যাবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সবলের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে মার্জার বা একীভূত করে লাভ হবে না। প্রয়োজন ব্যাংক খাতের প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করা। এছাড়া ব্যাংক খাতে এমন অনেক পরিচালক আছেন, যাদের হাতে ব্যাংক বড়ই অনিরাপদ। অর্থাৎ রক্ষক হয়েই তারা ভক্ষকের ভূমিকায় রয়েছেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকে কোনোদিন আস্থা ফিরে আসবে না।

জানতে চাইলে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আসলে এত ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া ভুল ছিল। আবার এখন যেসব দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটাও আরেকটা ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঋণখেলাপি।

মন্দমানের এ টাকা আদায়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সরকার। উলটো মার্জার এবং খেলাপি ঋণ কীভাবে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা যায়, বিভিন্ন সময় সে উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। এটা সরকারের ভুল নীতি। এছাড়া ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। ব্যাংক খাত উদ্ধারে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালদের শাস্তির কোনো বিকল্প নেই। মার্জার করে ব্যাংক খাতকে বাঁচানো যাবে না। মূল অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডুবন্ত ন্যাশনাল ব্যাংককে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইউসিবির ওপর। যা অনেক আগে লুট হয়ে গেছে। এতে ইউসিবি বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, জোর করে মার্জার করা ঠিক হচ্ছে না। বরং দরকার ছিল দুর্বলের সঙ্গে দুর্বল এবং সবলের সঙ্গে সবল ব্যাংক মার্জার করা। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে-তাতে সবল ব্যাংকও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে হবে পেশাদার মানুষ। শুধু ব্যাংকের মালিক হলেই বোর্ডে থাকতে পারবে না-এমন নীতিমালা থাকা দরকার। কারণ অনেক পরিচালক আছেন, যাদের হাতে ব্যাংক অনিরাপদ।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংককে অন্য পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কার্যত কিছুটা সবল ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের বোঝা। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পথনকশা দেওয়ার পর এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মাসের শুরুতে ব্যাংক একীভূত সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করেছে, তবে সে নীতিমালা জারির আগেই তিনটি ব্যাংক ও পরে দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী এই পর্যায়ে ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা স্বেচ্ছায়; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই নীতিমালা মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

যেসব ব্যাংক একীভূত হবে বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়, সেসব ব্যাংকের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন নির্বাহী জানান, কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংক একীভূত হবে, এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সভায় কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যাংকের ব্যক্তিরা, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু একটি ব্যাংকের পক্ষের ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, এই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে স্বেচ্ছায় বা ঐচ্ছিক ভিত্তিতে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো নিজেরাই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ অন্তত দুটি ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য কিংবা ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা নিজেরাও জানতেন না যে তাদের ব্যাংক অন্য দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চলেছে। যদিও নীতিমালায় বলা আছে, একীভূত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ফলে যেভাবে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া চলছে, তা নিয়ে ব্যাংক খাতে ইতোমধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্বল সূচকের ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছুটা ভালো তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোও অস্বস্তিতে পড়েছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কখন কাকে ডেকে কোনো দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে বলা হবে, তা আগে থেকে জানানো হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে, আপাতত স্বেচ্ছায় নতুন করে আর কোনো ব্যাংক একীভূত হবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেননা তীব্র তারল্য সংকট ও সুশাসন ঘাটতিতে থাকা কিছু ব্যাংক একীভূত করার এই প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছে। বিশেষ ব্যবস্থায় এসব ব্যাংকের লেনদেন চালু রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে বলে জানায় সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ এপ্রিল ব্যাংক একীভূত হওয়া সংক্রান্ত নীতিমালা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেবে। একীভূত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ৩ বছর পর্যন্ত পৃথক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন করতে পারবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে ৩ বছর পর অবশ্যই একীভূত হওয়া দুই ব্যাংকের সমন্বিত আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন শুরু করতে হবে। নীতিমালায় আরও উল্লেখ করা হয়, দুর্বল ব্যাংককে ২০২৫ সাল থেকে বাধ্যতামূলক একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এ কাজের খরচ জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায় ও সম্পদ গ্রহণের দরপত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ওই ব্যাংকের সব ধরনের তথ্য থাকবে। এতে সাড়া না মিললে যে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে ওই ব্যাংককে একীভূত করে দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল হিসাবে বিবেচিত ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এজন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করারও পরামর্শ দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও। ওই বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে।

১৪ মার্চ ইসলামি ধারার এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলাদা বৈঠক করে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

৩ এপ্রিল সরকারি খাতের দুটি ব্যাংককে অন্য দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। জানানো হয়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে মিলবে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। এরপর ৮ এপ্রিল বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি খাতের সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। আর সর্বশেষ ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত আসে।

সব মিলিয়ে পাঁচটি আলাদা বৈঠকে ব্যাংক একীভূত করার এসব সিদ্ধান্ত হয় এবং সবকটি বৈঠকই হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এসব বৈঠকে বেসিক ও ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়া সবকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে বেসিক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের ব্যাংক একীভূত যে হতে যাচ্ছে তা জানতেই পারেনি।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর পর্ষদে এই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের অনুমোদন হবে। অথচ নীতিমালায় আছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এ বিষয়ে আগে সিদ্ধান্ত নেবে।

একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাকে ডেকে পাঠানোর সময় বৈঠকের বিষয়বস্তুও জানানো হয়নি। শুধু সভায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে হবে। এটা একীভূত না অধিগ্রহণ হবে, সেই পরামর্শ করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। ব্যাংকের আর্থিক সূচক ভালো রাখা এই দেশে এখন অপরাধের পর্যায়ে চলে গেছে। সারা পৃথিবীতে এভাবে ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা জানা নেই।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন গভর্নর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উপদেষ্টা। অন্য কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে জানতেও পারছেন না। মার্জারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘আপাতত পাঁচ ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হবে। বাকিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরে।’(যুগান্তর)




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD