সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯ অপরাহ্ন




ভেতর-বাহির

বিএনপি’র জনসভা ধাবমান দুর্ভিক্ষ আর ‘তিউনিশিয়ার ভূত’

ডা. জাহেদ উর রহমান
  • প্রকাশের সময়: সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০২২ ৬:৩৯ am
রাজনীতি Bangladesh Nationalist Party BNP ‎বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বিএনপি গণসমাবেশ
file pic

প্রাথমিকভাবে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে টানা তিনটি মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা, নিজেকে সর্বশক্তিমান এবং অতি জনপ্রিয় দাবি করা একটি সরকার ‘তুচ্ছ’ একটি বিরোধী দলের ‘তুচ্ছ’ জনসভা ঠেকানোর জন্য এমন তো করার কথা নয়। এমন আচরণ, যেটা সরকারের অহম-এর জন্য খুবই ক্ষতিকর, সেটা কেন করছে তারা? নেহায়েত একটা জনসভার লোকসমাগম ঠেকানোর জন্য সরকারের আচরণ কি সরকারের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিচ্ছে না? ভীষণ কঠোর বাধা দেয়ার পরও যখন বিএনপি’র জনসভাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় হয় মানুষের, তখন সেটা কি সরকারকে আরও হাসির পাত্র করে দেয় না? আওয়ামী লীগের মতো প্রায় ৭৫ বছর বয়সী একটি পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দলের এগুলো না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারপরও তারা সেটা করছে

খুব নিয়মিতভাবে খুবই স্বল্প বিরতিতে প্রধানমন্ত্রী বার বার দুর্ভিক্ষ আসার কথা বলছেন। দুর্ভিক্ষ আসবে মানুষকে এই ব্যাপারে সতর্ক করে তিনি প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ, অপচয় রোধ, সঞ্চয় করা ইত্যাদি নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। দুর্মুখরা যদিও বলছেন দেশে এখনই কি নীরব দুর্ভিক্ষ নেই? এই প্রশ্নের মুখে আমার স্মৃতির পটে ভেসে উঠলো যখন টিসিবি’র ট্রাকে কার্ড ছাড়াই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করতো, তখন প্রথম আলো অনেকগুলো রিপোর্ট করেছিল সেখানকার লাইনে দাঁড়ানো মুখগুলোকে নিয়ে।

দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর মুখ থেকে স্পষ্টভাবে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে কিনা এবং সেটার কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও দ্রুত খারাপের পর্যায়ে যাবে কিনা এই আলাপগুলো আসতেই পারে। কিন্তু আমরা এভাবে যদি ভাবি এসব কিছু বোঝার পরও প্রধানমন্ত্রী এভাবে বলছেন এবং নিশ্চিতভাবেই তার কাছে দেশের অর্থনীতির ব্যাধি সংক্রান্ত তথ্য আমাদের চাইতে অনেক বেশিই আছে।

সরকারের দিক থেকে করোনা মহামারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সবকিছুর ফলাফল হিসেবে বৈশ্বিক মন্দাকে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আছে। কিন্তু এদেশের সচেতন মানুষ জানেন, বৈশ্বিক পর্যায়ের সংকটগুলোর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একেবারে ভেঙেচুরে ফেলতে পারছে; কারণ ভয়ঙ্কর দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে আগে থেকেই ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। যাই হোক, আমার আলোচনার বিষয় দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নয়, ধাবমান পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ। বিএনপি’র জনসভার সঙ্গে দুর্ভিক্ষের সম্পর্কের আলোচনায় আসার আগে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি’র জনসভা ঘিরে যা যা হচ্ছে সেটা নিয়ে কয়েকটি কথা।

‘নজিরবিহীন’ শব্দটা বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের বিরোধী দল নিপীড়নের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে ব্যবহার করা যায়। প্রতিটি নতুন সরকার নিপীড়নের মাত্রায় ছাড়িয়ে যায় আগের নজির।

এমনকি ক্ষমতাসীন একটি সরকারও বিরোধী দল দমনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তার আগের নজিরটি ছাড়িয়ে যায়। আগস্ট মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় বিএনপি’র জনসভায় নানা রকম পন্থায় বাধা সৃষ্টি করেছিল সরকার। সেই ধারা অব্যাহত আছে বিভাগীয় সমাবেশগুলোর ক্ষেত্রেও এবং দেখছি সরকারি দলের দমনের নজির ছাড়িয়ে যাওয়া।
বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশের পঞ্চমটি অনুষ্ঠিত হলো বরিশালে। বিভাগীয় সম্মেলনের তৃতীয়টি অনুষ্ঠিত হয়েছিল খুলনায়। চট্টগ্রামের সমাবেশটির তুলনায় অনেক বেশি বাধা দেয়া হয়েছিল ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের জনসভার দিন জেলাটিকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় সারা দেশ থেকে। খুলনার নজির ছাপিয়ে গেল ময়মনসিংহকে। দুইদিন আগে থেকেই খুলনা শহরটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় সারা দেশ থেকে। এমনকি বিএনপি’র সমাবেশে যাবার মতো ‘অপরাধ’ যারা করেননি, তারাও চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়লেন। একই পরিস্থিতি হলো রংপুরে। বরিশালেও হয়েছে একই ফর্মুলার বাস্তবায়ন। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি সামনের গণসমাবেশগুলোর পরিস্থিতিও একই হবে। আর যৌক্তিকভাবে অনুমান করা যায় বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে সবগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে ঢাকার মহাসমাবেশ।
এভাবে যানবাহন বন্ধ করার জন্য সরকারি দল পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটকে দোষ দিলেও দেশের মানুষ জানে এগুলো আসলে কেন হচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।

প্রাথমিকভাবে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে টানা তিনটি মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা, নিজেকে সর্বশক্তিমান এবং অতি জনপ্রিয় দাবি করা একটি সরকার ‘তুচ্ছ’ একটি বিরোধী দলের ‘তুচ্ছ’ জনসভা ঠেকানোর জন্য এমন তো করার কথা নয়। এমন আচরণ, যেটা সরকারের অহম-এর জন্য খুবই ক্ষতিকর, সেটা কেন করছে তারা? নেহায়েত একটা জনসভার লোকসমাগম ঠেকানোর জন্য সরকারের আচরণ কি সরকারের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিচ্ছে না? ভীষণ কঠোর বাধা দেয়ার পরও যখন বিএনপি’র জনসভাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় হয় মানুষের, তখন সেটা কি সরকারকে আরও হাসির পাত্র করে দেয় না? আওয়ামী লীগের মতো প্রায় ৭৫ বছর বয়সী একটি পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দলের এগুলো না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারপরও তারা সেটা করছে।

তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী। আগের বছরের নভেম্বরে ক্ষমতায় থাকার ২৪ বছর পূর্ণ করে ২০১১ সালের জানুয়ারির শুরুতে তিনি অত্যন্ত নিশ্চিত, নিরুপদ্রব শাসনকাল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। টানা ২৩ বছর ক্ষমতায় আছেন একজন প্রেসিডেন্ট এই তথ্যই আমাদের বোঝানোর জন্য যথেষ্ট, সেই দেশের নাগরিকরা কেমন ছিলেন। সবকিছুর পরও তার শাসনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন চলছিল না।

সে সময়টার কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনে পড়ে বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলার চেষ্টা করেন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের চরম ক্ষোভ থাকলে তারা রাস্তায় নেমে আসছে না কেন? অর্থাৎ তারা বোঝাতে চান সরকারের প্রতি মানুষের কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও সেটা তীব্র কিছু নয়; ক্ষোভ-ঘৃণা থাকার তো প্রশ্নই নেই। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় না নেমে আসা শুধু মোটা দাগের সন্তুষ্টিই না, মানুষের তীব্র ভীতিরও লক্ষণ।

যাক, ফিরে আসি তিউনিশিয়ায়। ডিসেম্বর মাসেও বেন আলী নিশ্চয়ই এক তুচ্ছ ফুটপাথে সবজি এবং ফল বিক্রি করা হকারের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় বিচলিত হননি। মোহাম্মদ বুয়াজিজি নামের মানুষটি ধারকর্জ করে পণ্য কিনে রাস্তায় ফল এবং সবজি বিক্রয় করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছিলেন। আমাদের পুলিশের মতোই তাদের পুলিশও তার কাছ থেকে অবৈধ টাকা দাবি করে এই অজুহাতে যে ফুটপাথে বসে ব্যবসা করা অবৈধ, বেআইনি। সেটা না করায় বুয়াজিজির ভ্যান পুলিশ নিয়ে যায়। তিনি থানায় যান এবং পরে যান গভর্নরের অফিসে অভিযোগ জানাতে। সেই অফিসে কী হতে পারে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চয়ই আমরা বুঝি। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করা হয় না এবং বুয়াজিজি ঘোষণা দিয়ে আসেন তার জিনিস ফেরত না পেলে তিনি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন। সত্যিই তিনি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

বুয়াজিজিকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি বেঁচেও থাকেন দুই সপ্তাহের বেশি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, মারা যান তিনি। প্রথমে তার নিজ এলাকায় কিছু প্রতিবাদ শুরু হয়, তারপর বড় বড় শহরগুলো সহ রাজধানীতেও প্রতিবাদ হয়। সেই প্রতিবাদে শুরুতে শামিল হয় খেটে খাওয়া মানুষেরা। তারপর দ্রুতই তাতে যুক্ত হন সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষরা। সেই আন্দোলন এত প্রচণ্ড হয়ে ওঠে যে, দশ দিনের মাথায় ২৩ বছর বজ্রকঠিন শাসন করা বেন আলি পালিয়ে যান দেশ থেকে। আমরা অনেকেই জানি এটাই আরব বসন্তের সূচনা।

আরব বসন্তের ফল কী হয়েছে, সে আলোচনা ভিন্ন। এই আলোচনাও আমরা সরিয়ে রাখবো যে, আরব বসন্তের পেছনে পশ্চিমাদের বিশেষ করে আমেরিকার ‘উস্কানি’-এর ভূমিকা আছে। কিন্তু এই কলামের জন্য এই তথ্যটুকু আমাদের জানা জরুরি স্বৈরশাসকদের অপশাসনে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে বছরের পর বছর। তিউনিশিয়ায় সেই ক্ষোভ হঠাৎই বেরিয়ে এসেছে বুয়াজিজির ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে কিনা সেই বিতর্ক সরিয়ে রাখি। দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্তত যখন বারবার বলছেন যে, দেশে দুর্ভিক্ষ আসছে, তার মানে সরকারি দলের বয়ানে একদা সিঙ্গাপুর হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে অন্তত সিঙ্গাপুরের মানুষদের মতো শান-শওকতে বাস করছে না। বাস্তবে বছরের পর বছর অপশাসনের মধ্যে থেকে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ক্রমাগত।

ন্যূনতম একটা কার্যকরী নির্বাচন ব্যবস্থা যদি থাকে তাহলে অন্তত পাঁচ বছর পর পর সরকারকে ভোট দিয়ে সরিয়ে ফেলে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয় কিছুটা। কিন্তু বাংলাদেশে ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে দিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের সুযোগ নেই এক দশক হয়ে গেল। সেই সুযোগ সামনে থাকবে কিনা, সেটা নিয়েও আছে চরম অনিশ্চয়তা। এটাও ক্ষোভ-ক্রোধকে বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ।

মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-ক্রোধের আগুনে তীব্র অভাবজনিত ক্ষুধা এবং অন্য সংকট চরম কতোটা ইন্ধন জোগাতে পারে, সেটা বোঝা যায় খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই। এই ক্ষোভ-ক্রোধের তীব্রতা কতোটা হতে পারে, সেটার বিস্তারিত তথ্য নানা গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চয়ই সংগ্রহ করছে অনেক আগে থেকেই। আর সেসব তথ্য নিশ্চয়ই পরিবেশিত হয় জরুরি ভিত্তিতে।

বিএনপি’র জনসভায় দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাইরেও মানুষ যোগ দিচ্ছে, এমন রিপোর্ট দেখছি মিডিয়ায়। নীরব দুর্ভিক্ষের মধ্যে বাস করে, সামনে একটা লঙ্গরখানা খোলার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মতো পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ সামনে রেখে বিএনপি’র জনসভায় কর্মহীন ভুখা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে জ্যামিতিক হারে। তারপর নানা কারণে অসন্তুষ্ট সাধারণভাবে গা বাঁচিয়ে চলা মধ্যবিত্তও যুক্ত হতে পারে সেখানে। এমনটা হওয়ার আগেই সরকারের সুচিন্তার উদয় হওয়া উচিত বলে মনে করে সুধীজনরা।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD