নিকাহনামা ফরমে ‘কুমারী’ শব্দের ব্যবহার নারীর জন্য অপমানজনক ও বৈষম্যমূলক বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, নিকাহনামায় কুমারী শব্দ রাখা নারীর জন্য অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সংবিধান ও সিডও সনদের (বৈষম্য বিলোপ সনদ) পরিপন্থী। কারণ একই ফরমে নারীর জন্য এই বিধান রাখা হলেও পুরুষের জন্য এ ধরনের কোনো বিধান নাই। যা সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এ কারণে রায়প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে নিকাহনামা ফরম থেকে ওই ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বিবাদীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হলো।বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দুই বছর আগে দেওয়া এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি চলতি সপ্তাহে প্রকাশ পেয়েছে।রায়ে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, নিকাহনামা ফরমের ৫ নম্বরে কুমারী শব্দ বাদ দিয়ে কন্যা অবিবাহিত, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কী না তা লিখতে বলা হয়েছে। এছাড়া নিকাহনামার ২১ নম্বর দফা সংশোধন করে সেখানে অনুরূপভাবে লিখতে হবে, বর বিবাহিত/অবিবাহিত/তালাকপ্রাপ্ত/বিপত্নীক কি না।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮(১)(ক) অনুযায়ী বিবাহ ফরমের ৫ নম্বরে কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কিনা সে বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ধরনের তথ্য চাওয়া বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নারীপক্ষ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ করা হলো।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেছেন, নিকাহনামার ২১ ও ২২ নম্বর দফায় বরের বর্তমানে কোনো বিবাহ বলবৎ আছে কি না, কেবল সে বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বর তালাকপ্রাপ্ত বা বিপত্নীক অথবা কুমার কি না, এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়নি। অন্যদিকে, ৫ নম্বর দফায় কন্যা তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা কি না, পাশাপাশি কন্যা আগে কোথাও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন কি না, এ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে যা অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট ও সংবিধানের পরিপন্থী।
এ ধরনের তথ্য চাওয়া সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষায় এ ধরনের হস্তক্ষেপ সংবিধান অনুযায়ী নারীর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। অবিবাহিত শব্দের পরিবর্তে কুমারী শব্দের প্রয়োগ নারীর জন্য অমর্যাদাকর ও অপমানজনক।বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী রায়ে বলেছেন, মুসলিম বিবাহ একটি চুক্তি ও পারস্পারিক সম্পত্তির মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ বিবাহের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সময়ে রেজিস্ট্রির কোনো বিধান ছিল না। জটিলতা এড়ানোর জন্য ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইনে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রির বিধান রাখা হয়েছে। সুতরাং, বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য বর ও কনের সার্বিক অবস্থা সমন্বিতভাবে হওয়া উচিত। এ কারণে কন্যা কুমারী কি না, এ শব্দ বাদ দিয়ে বাকি বর্ণনা বলবৎ থাকবে বলে মত দেন এই বিচারপতি।