ব্যবসায়ীরা যখন নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন, তখনই আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে চাহিদা মেটাতে সাতটি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে বলে হিসাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ কথা জানান।
এছাড়া, ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যাগুলো যাতে সরকারকে জানাতে পারেন, সেজন্য বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করবে বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত ‘বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি’র সভায় তিনি এ কথা জানান।
সভা শেষে সাংবাদিকদের কাছে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হওয়ার কথা স্বীকার করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো নভেম্বরে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের যে তথ্য দিয়েছে, প্রকৃত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম হবে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
সভায় আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
ওই প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, চলতি ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি ও গম আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এ পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে ৮১২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২২.১৯ লাখ টন গম, ৯৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৭ লাখ টন ভোজ্য তেল এবং ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
এছাড়া ছোলা আমদানিতে ১৩৪.৪৯ মিলিয়ন ডলার, খেজুর আমদানিতে ৫২.৬৭ মিলিয়ন ডলার এবং মসুর ডাল আমদানিতে ১৪০.৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘এলসি খোলাসহ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আমরা চিঠি লিখব এবং ফলোআপ নেব। সমস্যা সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নেব।
‘রোজায় ভোক্তাদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছি।’
সিটি গ্রুপ এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়েছে উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা বলেছেন, নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে কোনো সমস্যা হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে।’
আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে নিত্যপণ্যের এলসি খোলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করবে বলে জানান টিপু মুনশি।
অর্থপাচারকারী ও পণ্যে দাম বৃদ্ধিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সভায় বলেন, দু-চারজন ‘ব্ল্যাকশিপ’ অর্থপাচারকারীর জন্য ব্যবসায়ীদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকির কোন ক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ-এর সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে মন্ত্রণালয় অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, ‘বাজারে যারা পণ্য বিক্রি করেন, তাদের সবাই ফেরেশতা নন। চিনি নিয়ে কোথাও কোথাও সমস্যা হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের জেলে পাঠাব।’
চিনির শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি লিখবেন বলেও মন্তব্য করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এছাড়া চিনির মিলগুলোতে এখনও গ্যাস সংকট রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রপ্তানিকারকরা সভায় জানিয়েছেন, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সার্কুলার জারির কারণে নতুন করে সমস্যায় পড়ছেন তারা।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন শীর্ষ রপ্তানিকারক জানান, গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছে যে, কোনো ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে এলসি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ অথরাইজড ডিলার (এডি) লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
ওই রপ্তানিকারক বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা সময়মতো পণ্যের দাম দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আমরাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির পেমেন্ট করতে পারছি না। আগের এলসির পেমেন্ট না করে নতুন করে কোনো ব্যাংকে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না।’
বর্তমানে ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা এ সমস্যায় রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ সমস্যার সমাধানে বাণিজ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধও চেয়েছি করেন ওই রপ্তানিকারক।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের নভেম্বর মাসে রেকর্ড ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে।
এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। সভায় তিনি বলেন, ইপিবি রপ্তানির যে তথ্য দিয়েছে, তা এ যাবতকালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি। দেশে গ্যাস সংকট, রপ্তানি আদেশ কমে গেছে—এমন সময়ে এত বেশি রপ্তানি আয় ব্যবসায়ীদের তথ্যে সঙ্গে মিলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে হাতেমের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।
তারা দাবি করেছেন, কোন রপ্তানিকারক কোন দেশের কোন কোম্পানিতে কী পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে, সে তথ্য তাদের কাছে আছে। তাই ইবিপির রপ্তানি আয়ের তথ্যে কোনো ভুল নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরকারের সংস্থাগুলোর হয়তো সঠিক তথ্যই দিয়েছে। কিন্তু ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের স্টেটমেন্ট এবং বিভিন্ন ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে ইপিবির তথ্য মিলছে না বলে ব্যবসায়ীদের মনে হয়েছে।