মেট্রোরেলের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। যাত্রী কল্যাণের কয়েকটি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে ভাড়া পুনঃনির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। কোনো কোনো সংগঠন বলছে ভাড়া অর্ধেকে নামিয়ে আনতে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ভাড়া কমানোর দাবি তোলা হয়েছে। সর্বশেষ বিএনপিও ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দলটির পক্ষ থেকে ভাড়া কমানোর দাবি তোলা হয়েছে। ভাড়া কমানো বা যৌক্তিক করার দাবির বিষয়টি নিষ্পত্তির এখনো সুযোগ রয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের জন্য। কারণ শুরুতে সীমিত পরিসরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলবে। এই সময় যাত্রীর চাপ, চাহিদা ও ভাড়া সংগ্রহের বিষয়টি পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ
যানজটের শহর ঢাকায় স্বস্তির খবর হয়ে এসেছে মেট্রোরেল। ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার অংশ চালু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী হচ্ছেন। আর এই ট্রেন চালিয়ে নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন চালক মরিয়ম আফিজা। আজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর আগামীকাল থেকে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করবে মেট্রোরেল। প্রথমে সীমিত পরিসরে পরে পর্যায়ক্রমে পুরোদমে চলবে ট্রেন। এতে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে নির্বিঘ্ন যাত্রার এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। সড়কের যানজটের দুর্ভোগ ভুলে স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে পারবে সাধারণ মানুষ। দীর্ঘ ঘণ্টার যাত্রার পরিসর নেমে আসবে মিনিটে। নিঃসন্দেহে ঢাকায় গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আজ সকালে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেট্রো’র এলিট ক্লাবে প্রবেশ করছে দেশ। আজকের সকালটি ঢাকার বাসিন্দাদের স্বাগত জানাবে মেট্রোরেলের মতো নির্ভরযোগ্য, সময় সাশ্রয়ী স্বচ্ছন্দের গণপরিবহনে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই মেট্রোরেল গণপরিবহন হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।
ব্যয়বহুল হওয়ায় কম আয়ের দেশগুলো দেরিতে মেট্রোযুগে প্রবেশ করছে। জনবহুল ও যানজটের নগরগুলোতে এই মেট্রোরেল শুধু জনপ্রিয়ই না এটি অনেক সমস্যার সমাধানও। ঢাকার মতো জনবহুল এবং যানজটের শহরে এই মেট্রোরেল আরও আগেই হওয়া দরকার ছিল। মেগা বাজেটের বিষয় হওয়ায় হয়তো এটি আগের সরকারগুলো এমন প্রকল্পে চোখ দেয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই ঢাকায় মেট্রোরেল করার চিন্তা করে। ২০১২ সালে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সরকার এই সাহসী প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। ২০১৬ সালে ২৬শে জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ কাজের শুরু হয়েছিল। প্রায় ছয় বছরের মাথায় রাজধানীর প্রথম মেট্রোরেল-এমআরটি লাইন-৬ এর আংশিক উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। আগামী বছরের এই সময়ে মতিঝিল পর্যন্ত পুরো ২০ কিলোমিটার লাইন উদ্বোধন হতে পারে। পরের বছর ট্রেন যাবে কমলাপুর পর্যন্ত। এরপর আরও দু’টি রুটে মেট্রোরেল চালু হবে। এই দুই রুটের নির্মাণ কাজ শুরু হবে অচিরেই। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড এই মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জাপানি সংস্থা জাইকা এমআরটি-৬ এর বড় অর্থদাতা।
সরকার অর্থের একটি অংশের যোগান দিয়েছে। ঢাকায় প্রস্তাবিত সবগুলো মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এক সময় রাজধানীর পুরো চেহারাই বদলে যাবে। যানজটে ধুঁকতে থাকা নগরে যাতায়াতের দুর্ভোগ কেটে যাবে। বাঁচবে সময়, শ্রম আর অর্থ। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল রুটটি নির্মাণের সময়ে এই পথে চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ ছয়টি বছর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে মিরপুরের বাসিন্দারা মেট্রোরেলের প্রসব বেদনা অনুভব করেছেন পুরো সময়জুড়ে। কষ্ট হলেও মানুষ অপেক্ষায় ছিল মেট্রোরেল চালু হবে। সহজে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করা যাবে। অপেক্ষার পুরো না হলেও আংশিক অবসান হয়েছে। সড়কের দুর্ভোগ কেটে গেছে। সড়কটি এখন ঝকঝকে তকতকে। ফুটপাথগুলো সংস্কার করা হয়েছে। সড়ক বিভাজক সেজেছে নতুন সাজে। একইসঙ্গে মেট্রোরেলও হাতছানি দিচ্ছে। আজ উদ্বোধনের পর আগামীকাল থেকে যে বাণিজ্যিক যাত্রায় যাচ্ছে মেট্রোরেল সেখানে হয়তো সবাই উঠতে পারছেন না। তবে সময় গড়ালে সবার জন্যই উন্মুক্ত হবে মেট্রোরেল। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশনের মধ্যে সরাসরি চলবে ট্রেন। মাঝে অন্য স্টেশনে দাঁড়াবে না। পরে পর্যায়ক্রমে খুলবে বাকি সাতটি স্টেশন।
ইতিমধ্যে স্টেশনগুলোর সার্বিক কাজ এবং প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে প্রথম দিকে সকাল আটটা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলবে ট্রেন। এই সময়ে প্রতি ১০ মিনিট পর পর এক একটি ট্রেন ছেড়ে যাবে। প্রতি ট্রেনে সর্বোচ্চ ২০০ জন করে যাত্রী যাবেন। সহজ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে মেট্রোরেল স্বস্তির খবর হয়ে এলেও এর যাতায়াত ব্যয় নিয়ে কিন্তু প্রশ্নের শেষ নেই। মেট্রোরেলের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে অনেকে এটিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তা ঢাকায় বিদ্যমান গণপরিবহনের ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশের মেট্রোর ভাড়ার চেয়ে তিন থেকে পাঁচগুণ ভাড়া হচ্ছে ঢাকার মেট্রোতে। প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা হারে ঢাকার প্রথম মেট্রোর সর্বোচ্চ ভাড়া হবে ১০০ টাকা। এ ছাড়া মেট্রোরেলে চড়লেই গুনতে হবে ন্যূনতম ২০ টাকা ভাড়া। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো বিবেচনায় এই ভাড়া যৌক্তিক না। বিদ্যমান গণপরিবহন এর সমান বা এর চেয়ে সামান্য বেশি হলেও মানুষের জন্য ভাড়া গ্রহণযোগ্য হতো।
এখন যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এই ভাড়ায় এই রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী মানুষের সময় সাশ্রয় হবে ঠিকই কিন্তু তাদেরকে বাড়তি চাপে পড়তে হবে। যাতায়াতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। বাড়তি ভাড়ার কারণে নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করেন এমন অনেকে হয়তো কষ্ট করে আগের মতোই বাসে চড়ে গন্তব্যে যাবেন। ধরেন উত্তরা থেকে মতিঝিলে গিয়ে অফিস করা সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নিম্ন স্তরের কোনো কর্মীর পক্ষে এই ভাড়া মেটানো দুষ্কর হবে। কারণ প্রতিদিন যাতায়াতে তার দুইশ’ টাকা খরচ হবে। মাস হিসেবে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। অগ্রিম টাকা দিয়ে কার্ড রিচার্জ করলে হয়তো ভাড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা রেয়াত পাওয়া যাবে। এ ছাড়া গার্মেন্টস কর্মী, সাধারণ শ্রমিক যারা স্বল্প বেতনে কাজ করেন তাদের জন্য মেট্রোরেল হয়তো কোনো সুখবর নয়। কারণ বিদ্যমান ভাড়ায় তাদের নিয়মিত ট্রেনে চড়া কষ্টকর হবে।
ভাড়ার কারণে যদি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করতে না পারেন তাহলে তো এটি পুরোপুরি গণপরিবহন বলা যাবে না। উদ্বোধনের আগে গতকাল আগারগাঁওয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন ভাড়া নিয়ে। তিনিও পরিষ্কার জবাব দেননি। বলেছেন, মেট্রোরেলে যে সুবিধা পাওয়া যাবে সেই তুলনায় ভাড়া বেশি না। মেট্রো রেলের প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সে অনুযায়ী মেট্রোরেল লাভ করতে পারবে না। প্রশ্ন হলো গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেলে লাভের প্রশ্ন আসছে কেন? এটি সত্য মেট্রোরেলে বড় যে বিনিয়োগ এসেছে সেই অর্থ তুলতে হবে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অল্প হলেও তাদের মুনাফা তুলবে। তবে এটি তুলতে গিয়ে বাড়তি ভাড়ার চাপ মানুষকে দেয়া ঠিক হবে না বলে অনেকে বলছেন। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি ভাড়ায় কম যাত্রী বহনের পরিবর্তে তুলনামূলক কম ভাড়ায় বেশি যাত্রী পরিবহন করলে সুবিধা বেশি মিলবে। এতে সব মানুষ যাতায়াতের সুবিধা পাবে। এ ছাড়া কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে মানুষকে অভ্যস্ত করে তুললে পর্যায়ক্রমে ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ তো থাকেই। নগরপরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে মেট্রোরেলে মানুষ অভ্যস্ত হলে ভাড়া কিছু বেশি হলেও এতে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
মেট্রোরেলের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। যাত্রী কল্যাণের কয়েকটি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে ভাড়া পুনঃনির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। কোনো কোনো সংগঠন বলছে ভাড়া অর্ধেকে নামিয়ে আনতে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ভাড়া কমানোর দাবি তোলা হয়েছে। সর্বশেষ বিএনপিও ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দলটির পক্ষ থেকে ভাড়া কমানোর দাবি তোলা হয়েছে। ভাড়া কমানো বা যৌক্তিক করার দাবির বিষয়টি নিষ্পত্তির এখনো সুযোগ রয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের জন্য। কারণ শুরুতে সীমিত পরিসরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলবে। এই সময় যাত্রীর চাপ, চাহিদা ও ভাড়া সংগ্রহের বিষয়টি পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
এখন দেখার বিষয় মেট্রো কর্তৃপক্ষ কেবল লাভের হিসাব কষে বাড়তি ভাড়া নিয়ে থাকবে নাকি সাধারণ মানুষের চাহিদা বিবেচনা করে ভাড়া কমিয়ে মেট্রোরেলকে পুরো গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তুলবে। বলা হচ্ছে বাড়তি ভাড়ার কারণে মেট্রোরেল পরিণত হবে এলিট বা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের বাহন হিসেবে। জনগণের অর্থ খরচ করে শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণির সুবিধা তৈরি করা আসলে কোনো সরকারি প্রকল্পের উদ্দেশ্য হতে পারে না। হওয়া উচিতও না। আমরা মনে করি ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল শুধু আমাদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে থাকবে না। বাস্তবিক অর্থে গণপরিবহন হিসেবে সব মানুষের, সব নাগরিকের নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: মানবজমিনের নগর সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদক