সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:০৪ অপরাহ্ন




মাদারীপুরের খেজুরগাছ গিলে খাচ্ছে ইটভাটা

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ১২:২৫ pm
khejurer Dates date palm flowering plant trees sweetest fruits Khejur Khajoor খেজুর গাছ খেজুর রস খেজুরের খেজুর গাছ খেজুর রস date tree
file pic

‘খেজুর রস, খেজুর গুড়, দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর’ এক সময়ের এই স্লোগান এখন শুধুই বুলি। গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এ জেলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছের সংখ্যা। দিন দিন কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে রসের পরিমাণ। শীত মৌসুম এলে খেজুরের গুড়ের চাহিদা বাড়লেও গুড় তৈরির প্রধান কাঁচামাল খেজুরের রসের সংকট দেখা দিয়েছে। এখানকার ইটভাটাগুলোতে এখন জ্বালানি হিসেবে অন্য গাছের সঙ্গে খেজুরগাছও পোড়ানো হয়। এতে জেলাজুড়ে খেজুরের রস কমে যাওয়ায় বেড়েছে ভেজাল গুড় তৈরির হিড়িক।

জেলার বিভিন্ন এলাকার গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন যতই যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে খেজুরগাছ। যা টিকে আছে, তাতে আগের মতো রস হয় না। তাছাড়া খেজুর বাগান বলতে যা বোঝায়, তা এখন খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। ১০ থেকে ১২টি গাছ মিললেও সেখান থেকে পর্যাপ্ত খেজুরের রস পাওয়া যাচ্ছে না। রসের পরিমাণ কম হওয়ায় ‘খাটি গুড়’ তৈরি করে সরবরাহ করা কষ্টসাধ্য। তাতে দামও বেশি পড়ে। বেশি দাম দিয়ে ‘শখের বসে’ কেউ কেউ কিনলেও সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। এছাড়া দাম ভেদে গুড়ের মান নির্ধারণ হয়ে থাকে। চিনি কম মেশানো গুড়ের দাম বেশি। আর সম্পূর্ণ চিনি ছাড়া এক কেজি গুড় ৫০০ টাকা করে বিক্রি করতে হয়। এছাড়া স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রির জন্য তৈরিকৃত খেজুরের গুড়ে চিনি মেশানো হয়ে থাকে।

জেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে মাদারীপুরে ৭৫ হেক্টর জমিতে ৮৪ হাজার ৯৮৬টি খেজুরগাছ ছিল। সে সময় গাছির সংখ্যা ছিল ৫৬০ জন। বর্তমানে এ জেলায় ৪৪ হেক্টর জমিতে ৪৫ হাজার খেজুরগাছ রয়েছে। আর গাছি রয়েছেন মাত্র ২৭০ জন। এর ফলে কমেছে খেজুরের রস সংগ্রহের পরিমাণ। এই সুযোগে বেড়েছে বিশুদ্ধ রস ও গুড়ের দাম।

মাদারীপুর সদর উপজেলার আশেপাশের ইটভাটাগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার সামনে খেজুরগাছের গুঁড়ি স্তূপ রাখা হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের দাবি, ইটভাটায় এখন জ্বালানি হিসেবে অন্য অন্য গাছের সঙ্গে পোড়ানো হচ্ছে খেজুরগাছ। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার খেজুরগাছ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই খেজুর রস ও গুড় রক্ষায় সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে গাছিদের সহযোগিতার দাবি এলাকাবাসীর।

পৌর শহরের মিলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আগের মতো রস না থাকায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে রস ও গুড়। আগে এক হাঁড়ি রসের দাম ছিল ৮০-১০০ টাকা। আর এখন তা ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ৮০-১০০ টাকার গুড় এখন কেজি প্রতি ২৫০-৩০০ টাকা দরে বিক্রি চলছে।

হোগলপাতিয়া গ্রামের আলিম আকন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহ করতেন। আগে প্রতিদিন কয়েকশ গাছ কাটতেন। বর্তমানে সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৩০-৪০টিতে। এ পেশায় কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। অথচ সে অনুযায়ী মজুরি পাওয়া যায় না। খেজুরগাছ ও রস কমে যাওয়ায় তিনিও আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই এ পেশায় ইতি টানবেন।

আরেক গাছি নূরুল ইসলাম ঘরামী বলেন, আগে ২৬০-এর ওপরে গাছ কাটতেন। কিন্তু এখন আর সেরকম কোনো গাছ নেই। গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। খেজুরগাছ কাটলেও তাতে আগের মতো রস পাওয়া যায় না। তাই শ্রমের মূল্যও পাওয়া যায় না। তারপরও বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। তার দাবি সরকারি সাহায্য সহযোগিতা।

নুরুল ইসলাম নামের আরকে গাছির আক্ষেপ করে বলেন, এখানকার খেজুরগাছ গিলে খাচ্ছে ইটভাটা। খেজুরের রসের সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন করেও লাগানো হচ্ছে না কোনো খেজুরগাছ। আমার দাবি সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

মাদ্রা গ্রামের আবদুল আজিজ মাতুব্বর বলেন, আগে শীতের সকালে একেবারে ভোরে ১০টি খেজুরগাছে অন্তত ৭ হাঁড়ি রস পেতাম। এখন একটা গাছও নেই। এখন আমি ও আমার পরিবারের কেউ রসের স্বাদ পাই না। এখন যাও কয়টা খেজুরগাছ আছে, আগামীতেও তাও থাকবে না।

এদিকে খেজুরের রস কমে যাওয়ার সুযোগে মাদারীপুরের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আসায় চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। খেজুরগাছ, গুড় ও রসের কারণে মাদারীপুর জেলার ব্র্যান্ডিং হিসেবে পাটালি গুড়কে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। তাই এ ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান এলাকাবাসী।

মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, খেজুরগাছ না কাটার জন্য আমরা জনগণকে সচেতন করছি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের অভিযানও চলে। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। কেউ যদি আইন অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে খেজুরগাছ লাগানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

খেজুরগাছ চাষে আগ্রহ বাড়াতে গাছিদের প্রণোদনা দেওয়ার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন। তিনি বলেন, মাদারীপুরের গুড়ের ঐতিহ্য যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যারা চিনি ও ভেজাল দিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করেন, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD