শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন




পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায় চাপল জবাবদিহিহীনতা ও অপর্যাপ্ত সময়ের ওপর

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: রবিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৩ ১২:২২ pm
Boi Mela Dhaka Book Fair Amor Ekushe Grantha Mela Ekushey Book Fair অমর একুশে গ্রন্থমেলা বইমেলা বই মেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি চত্বর book fair নতুন বই উৎসব
file pic

এ বছর ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির জন্য লেখা ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে ভুল তথ্য ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা।

শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মতে, দায়বদ্ধতা না থাকা এবং পর্যাপ্ত সময় ও পারিশ্রমিক বরাদ্দ না থাকায় বারবার বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ত্রুটি, লেখা কপি ও ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে।

এ বছরের অন্তত আটটি পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া গুরুতর ভুলের জন্য নানা মহলের সমালোচনায় জর্জরিত হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পাঠ্যক্রম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার পরেও ভুল বন্ধ না হওয়ায় আমরা লজ্জিত, বিব্রত। এজন্য এনসিটিবিতে যারা দায়িত্বরত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’

তবে লেখকদের শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার এনসিটিবির নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ভুলের জন্য দায়ী লেখককে আমরা পরবর্তীতে আর কোনো দায়িত্ব না দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। এর বাইরে তাদের আর কোনো শাস্তি দেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। এটা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখতে পারে।’

ভুলের অভিযোগ ওঠার পর এনসিটিবি কিছু ভুল সংশোধন করেছে এবং বলেছে যে তারা এখন আরও ত্রুটি বের করার জন্য অন্যান্য বই যাচাই করছে। পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বই ‘অনুসন্ধানী পাঠ’-এর একটি অংশ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।

এছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন ইংরেজি পাঠ্যবই, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই, চতুর্থ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ইংরেজি সংস্করণের বই এবং নবম-দশম শ্রেণির তিনটি পাঠ্যবইয়ের বিরুদ্ধেও ভুল, ভুল তথ্য ও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে।

নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ে চারটি, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে তিনটি এবং ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ে দুটি ভুল পাওয়া গেছে।

এই সাম্প্রতিক ভুলগুলো ২০১৩, ২০১৭ ও ২০২১ সালের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে করা বেশ কয়েকটি পূর্ববর্তী ভুলকেও সামনে নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি (বুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা যোগ্যমানের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে পারিনি। বরং বরাবরই দেখা যাচ্ছে যে পাঠ্যপুস্তকে অনেক ভুল, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত না।’

বারবার বই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে কায়কোবাদ বলেন, ‘স্কুল-কলেজে যা পড়াব, তার উদ্দেশ্য হলো বাচ্চাদের ভিত্তিটা শক্ত করে দেয়া। সে ভিত্তিটা বারবার পরিবর্তন হবে না। যেমন যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, অ্যালগরিদম—এগুলো তো কথায় কথায় পরিবর্তন হবে না।’

উন্নত পাঠ্যক্রম করতে হলে তিন মাসের সময় দিয়ে টেন্ডার করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভালো শিক্ষক কখনেও টেন্ডারে অংশ নেবেন না। যে বইয়ের ৩০ লাখ কপি আমরা ছাপাব, তা অত্যন্ত বড় মাপের দক্ষ শিক্ষক দিয়ে রচনা করতে হবে। তাতে যদি পাঁচ বছর লাগে, সে সময় নিয়েই বইটা রচনা করতে হবে। সে বইটি আমরা ৩০ বছর পাঠ্য হিসেবে রাখব। এভাবে আমরা লেখককে অনেক টাকাও দিতে পারব।’

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির একটি পাণ্ডুলিপির জন্য লেখকরা মোট ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সম্পাদনার জন্য ৬০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।’

একটি বই ছয়-সাত বছরের বেশি পড়ানো সম্ভব হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে পাঠ্যক্রম খুব দ্রুতই পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। তাই দীর্ঘসময় একই বই চালানো সম্ভব নয়।’

এ বছর শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীরা দুই ধরনের বই হাতে পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুন বই পেয়েছে। আর অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই পেয়েছে।

আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণি ও দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে।

ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ইতিহাস বিকৃতি ও ভুল তথ্য

এ বছর ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির জন্য লেখা ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে ভুল তথ্য ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা। উভয় শ্রেণিতে একই বিষয়ের ওপর ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ ও ‘অনুশীলনী পাঠ’ নামে দুটি করে বই রচিত হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির ‘অনুশীলনী পাঠ’ বইটির তৃতীয় পৃষ্ঠার ‘বাংলা অঞ্চলে ক্ষমতার পালাবদল’ শিরোনামের অংশে লেখা হয়েছে ‘বখতিয়ার খিলজি বেশ কিছু বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন।’

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে এ তথ্যের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। চমকে যাওয়ার মতো আরও কয়েকটি ইতিহাস বিকৃতি নজরে পড়েছে। আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্পর্কেও অনেক তথ্যবিভ্রাট রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ভাষা-বানানসহ একনজরে দেখে যা মনে হলো, তাতে সম্ভবত সংশোধনী দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। অমন বই শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা ন্যায়ত ও আইনত অপরাধ হবে বলে আমি মনে করি।’

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিষয়বস্তু শিশুদের উপযোগী নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এমডি মিজানুর রহমান বলেন, ‘বইটিতে বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনে নানা চাতুর্যের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিহাসিক ও প্রোপাগান্ডামূলক। যেমন মুসলিম শাসকদের “বহিরাগত” এবং “দখলদার” এবং আক্রমণকারী ও বর্বর হিসেবে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তা ইতিহাসের গবেষণায় অপ্রমাণিত।’

বইটি রচনার সঙ্গে যুক্ত ১১ লেখক ও সম্পাদকদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম।

তিনি বলেন, ‘সমগ্র বইয়ের খণ্ডিত একটি অংশ তুলে ধরে অনেকে সমালোচনা করছে। পুরো কনটেন্ট দেখলে এরকম সমালোচনা হতো না। ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই আমরা লিখেছি। সংশোধনীর বিষয়টি এনসিটিবি দেখবে।’

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব শিক্ষক বইটি রচনা করেছেন তাদের ব্যাপারে আমরা খতিয়ে দেখছি যে এক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তথা উদ্দেশ্য কী ছিল। ভিন্ন কারো প্ররোচনায় বা সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার জন্য ইতিহসা বিকৃতি হয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করা হচ্ছে।’

এ পর্যন্ত চলতি শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে বিতরণ করা মাধ্যমিক স্তরের তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলভ্রান্তির সত্যতা পেয়েছে এনসিটিবি। এজন্য ভুলগুলো সংশোধন করে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনীগুলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হবে। তারা সেগুলো বিদ্যালয়গুলোতে সরবরাহ করবেন।

ভুলগুলোর মধ্যে নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছিল, ‘২৬শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাত থেকেই নিরীহ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’

একই বইয়ের ২০০ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।’

অথচ প্রকৃতপক্ষে ওই সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন ওই সময়ের নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সংশোধনীতে এখন প্রকৃত তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে।

একইভাবে এনসিটিবি এ বইগুলোর অন্যান্য অংশেও সংশোধনের কথা উল্লেখ করেছে।

এদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে বানান ভুলসহ ৪০টির বেশি ভুল চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব বিষয় নিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকলে তা সংশোধন করা হবে। [টিবিএস]




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD