আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে এবং সব দল তাতে অংশ নেবে বলে ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে সরকার। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশা, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন হবে বাংলাদেশের আগামী সরকার। একই সঙ্গে শিল্প কারখানার কর্ম পরিবেশ উন্নয়নের তাগিদ দেন তারা। বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সন্তুষ্ট কিনা, তা জানতে চেয়েছে ইইউ প্রতিনিধি দল। এর পাশাপাশি তিন সচিবের সঙ্গে বৈঠকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নিবর্তনমূলক আটকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে।
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তিন সচিবের সঙ্গে বৈঠকে উঠে আসে এসব বিষয়। এ সময় গার্মেন্টস খাতের চলমান পরিস্থিতি, সংসদে পাশ হওয়া শ্রম আইন, কার্যকর শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে দু’পক্ষই।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে অংশ নেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসান ই ইলাহী। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা প্যাম্পেলোনির নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
পরে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জানান, গার্মেন্টস খাতের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই প্রতিনিধি দলের সফরের কোনো সম্পর্ক নেই। একইসঙ্গে জেনেভায় মানবাধিকার নিয়ে শুনানির সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও কোনো যোগসূত্র নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রতিনিধিদল। একইসঙ্গে প্রতিনিধিদলটি আশা প্রকাশ করেছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামী সরকার গঠন করবে বাংলাদেশ।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র-সচিব মাসুদ বিন মোমেন। পররাষ্ট্র-সচিব বলেন, ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি ইইউর প্রতিনিধি দল। কিন্তু এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইইউর প্রতিনিধি বলেছে, শতকরা ৫৬ ভাগ যে মজুরি ঘোষণা এসেছে এটার সঙ্গে সবাই একমত নন। তারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা আশা করছে, বর্তমানে শ্রম খাতে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থানসচিব এহছানে ইলাহী বলেন, ‘শ্রম খাতের উন্নয়নে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার ৯টি লক্ষ্যের ৮০ শতাংশ আমরা পূর্ণ করেছি। সংশোধন নিয়ে তারা জানতে চেয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে আইএলও সন্তুষ্ট কিনা, জানতে চেয়েছিল ইইউ প্রতিনিধি দল। আমরা বলেছি, এ প্রক্রিয়ায় আমরা আইএলওর সঙ্গে যুক্ত আছি।’
পররাষ্ট্রসচিব জানান, আলোচনায় মানবাধিকারের কিছু কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নিবর্তনমূলক আটকের বিষয়ে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনার আলোকে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তবে তারাও আশা করে যে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।’
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৫ ভাগ আসে পোশাকশিল্প থেকে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাদের জন্য যদি জিএসপি প্লাস থাকে এবং একই সঙ্গে এ খাত যদি শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে থাকে তাহলে তো এটা অর্থহীন। তাই আমরা পোশাকশিল্প খাতকে যুক্ত করতে বলেছি। জিএসপি প্লাসের বাংলাদেশ এর মধ্যেই ৩২ সনদ সই করে বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে আছে। আমরা বলেছি আমাদের পোশাকশিল্প খাতের সাফল্যকে শাস্তি দেয়া যাবে না। সাফল্যকে উৎসাহিত করতে হবে।’
বাংলাদেশের নির্বাচন বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রমিকদের আন্দোলনের সম্পর্ক নেই জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, চার-পাঁচ বছর পর শ্রমিকরা এ রকম আন্দোলন করে। এটার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। আর টাইমিংটা একেবারে কাকতালীয়।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে বিজিএমইএ অফিসে এক বৈঠকে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান শ্রম অসন্তোষ এবং ন্যূনতম মজুরি বিষয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) নেতাদের কাছে জানতে চান ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল।
সভায় উপস্থিত বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, আমরা তাদেরকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছি। আমরা বলেছি, বাহিরাগতরা এসে জড়িয়েছে, যার কারণে এটি বেড়েছে। এ বিষয়ে চাইলে ভিডিও ফুটেজও আমরা তাদের পাঠাতে পারি বলে জানিয়েছি। এ ছাড়া তারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) রোডম্যাপ অনুযায়ী অগ্রগতির বিষয়েও বিজিএমইএ’র কাছে জানতে চায়। বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে এ খাতের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত রানা প্লাজা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে।
গত ১২ই নভেম্বর ইইউ প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন; তাদের এ সফর আগামী ১৬ই নভেম্বর শেষ হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, শ্রম খাতের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘অগ্রগতি পর্যালোচনা’ করার লক্ষ্যে এই সফর। বাংলাদেশ শ্রম খাতে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০২১-২০২৬) গ্রহণ করেছে এবং এই পরিকল্পনাটি আইএলও গভর্নিং বডির কাছে বাংলাদেশ সরকারের জমা দেয়া রোডম্যাপের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। রোডম্যাপের লক্ষ্য হলো সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সম্মিলিত দরকষাকষির অধিকার সহ দেশের শ্রম অধিকারগুলো পালনের উন্নতি করা।