পরিবারে যখন কোনো ত্যাগ বা ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন নারীরাই এগিয়ে আসেন বা তাঁদের ঘাড়েই কোপটা দেওয়া হয়। মহামারির সময়ও দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক নারী কাজ ছেড়েছেন বা কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মহামারি বিশেষ সময়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ে বা সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্তের বলি হন নারীরা।
কোভিড-১৯-এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অসমতা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে চলতি বছর বিশ্বের আরও প্রায় ২৭ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। তাতে সব মিলিয়ে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৮৬ কোটি, যাদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের নিচে। বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবেন নারী ও শিশুরা।
অক্সফামের ‘দ্য অ্যাসল্ট অব অস্টিয়ারিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি, বিশ্বে ২০২০ সালের চেয়ে গত বছর নারীদের নিয়োগ দেওয়ার হার কমেছে; যদিও তাঁদের শ্রম, সুরক্ষা ও জীবনের ওপরে দাঁড়িয়েই রাস্তা তৈরি হচ্ছে করোনা-পরবর্তী আর্থিক প্রবৃদ্ধি।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের প্রায় সব দেশ যেভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করছে বা কৃচ্ছ্রসাধন করছে, সে কারণেও নারীদের দুর্ভোগ বাড়ছে। অক্সফামের মতে, বিভিন্ন দেশে পানিসহ বিভিন্ন জরুরি খাতে ব্যয় কমার কারণে খাটনি বেড়েছে নারীদের। মহামারির চূড়ায় পারিবারিক দায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২০ সালে নারীদের বাড়তি কাজ করতে হয়েছে ৫১ হাজার ২০০ কোটি ঘণ্টা—পারিশ্রমিক ছাড়াই। ফলে তাঁরা শারীরিকভাবেও নানা সমস্যার শিকার হচ্ছেন। এসব কারণেই ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নারীদের কথা মাথায় রাখা উচিত বলে মনে করে অক্সফাম।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করছে শীর্ষ ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমাচ্ছে সরকার। ভারতে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ কমেছে, গ্রামে যে প্রকল্পে বেশি কাজ করেন নারীরা। উচ্চ বেকারত্বের সময়ে বরাদ্দ ছাঁটাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে জানাচ্ছেন সে দেশের অর্থনীতিবিদেরা।
এই সংকট থেকে বের হওয়ার পথও বাতলে দিয়েছে অক্সফাম। এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অনেকটা ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির মতো। তাদের মতে, বিভিন্ন দেশের সরকার জরুরি ব্যয় হ্রাস করে ২০২৩ সালে যে অর্থ বাঁচানোর কথা ভাবছে, ধনীদের ওপর বাড়তি বা অনুক্রমিক কর আরোপ করে সেই ব্যয় সংকোচন থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি এই দুর্যোগের সময় বাংলাদেশসহ অনেক দেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হচ্ছে। তারা যেসব শর্ত দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যয় সংকোচন। অক্সফাম মনে করছে, আইএমএফের উচিত, এসব শর্ত থেকে বেরিয়ে আসা। এ ছাড়া তাদের দাবি, ধনী দেশগুলো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে বিনা সুদে ঋণ দিক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রতি পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্তত চারটি দেশ কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অবলম্বন করেছে। এসব দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে ব্যয় হ্রাস করা হচ্ছে। কিন্তু এসব দেশের সরকার ধনীদের ওপর কর ও উইনডফল ট্যাক্স (যেসব কোম্পানি হঠাৎ করে বিপুল মুনাফা করেছে) আরোপ করছে না। প্রায় অর্ধেক দেশের সরকার নারী ও শিশুদের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের ভাবখানা এমন, নারী ও শিশুরা যেন খরচযোগ্য।
অক্সফামের নারী-পুরুষ সমতা ও অধিকার বিভাগের প্রধান আমিনা হেরসি প্রতিবেদনে বলেছেন, এসব কৃচ্ছ্রসাধনের শারীরিক, আবেগীয় ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নারীদের বহন করতে হয়। কারণ, তাঁরাই এসব সেবার ওপর সবচেয়ে নির্ভর করেন। সে জন্য তাঁর মত, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নারীদের প্রতি সহিংসতার নামান্তর।
ব্যয় সংকোচন বা কৃচ্ছ্রসাধন অনিবার্য নয় বলেই মনে করে অক্সফাম। সরকার যেমন ব্যয় হ্রাস করে মানুষের ক্ষতি করতে পারে, তেমনি যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাঁদের ওপর কর আরোপ করতে পারে। বিষয়টি হচ্ছে, ২০২৩ সালে বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়ের চিন্তা করছে, বিশ্বের কোটিপতিদের ওপর অনুক্রমিক কর আরোপ করে তার চেয়ে অন্তত ১ লাখ কোটি ডলার বেশি আয় করা সম্ভব।
সম্প্রতি জাতিসংঘের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশের শিশু ও নারীরা ইতিমধ্যে খারাপ অবস্থায় আছেন এবং অক্সফাম বিশ্বাস করে, এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে:
১. অনেক শিশু ও নারী দারিদ্র্যের কাতারে যোগ দিচ্ছেন, অর্থাৎ তাঁদের দৈনিক আয় ৫ দশমিক ৫০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
২. কাজে ফেরার ধারায় নারীরা অনেক পিছিয়ে আছেন। ২০১৯-২২ সালে নতুন যত কর্মসংস্থান হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ২১ শতাংশ পেয়েছেন নারীরা। আবার এসব কাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি শোষণমূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৩. সেবামূলক কাজে নারীদের শ্রম আরও বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ২০২৩ সালে ব্যয় সংকোচন নীতির জমানায় বসবাসরত মানুষের হার হবে প্রায় ৮৫ শতাংশ, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার। অথচ বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ২ শতাংশ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যথেষ্ট।
আমিনা হেরসি বলেন, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি কার্যত পিতৃতন্ত্র ও নব্য উদারনীতিবাদী ভাবাদর্শের মিশেলে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে আরও নিপীড়ন করার হাতিয়ার।