সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৬ অপরাহ্ন




বাংলাদেশ নিয়ে কেন মুখোমুখি রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র?

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ১:২৭ am
Vladimir Putin president ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন রাশিয়া প্রেসিডেন্ট putin Russian-Flag ওয়াশিংটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা North America United States United State usa USA Russia রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র
file pic

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ঢাকায় মুখোমুখি দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এ বিষয়ে দেশ দুটির ঢাকা দূতাবাস দিয়েছে বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেকোনো দেশের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতির জন্য বিদেশিদের চেয়ে অনেকাংশে দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোই দায়ী।

ঘটনার সূত্রপাত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে। সেদিন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৩ বছর আগে নিখোঁজ বিএনপি এক নেতার বাসায় যান। বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনাকে পিটার হাসের বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতিতে প্রবেশ হিসেবে দেখছেন।

এ সফরের সময় সেখানে পিটার হাসের কাছে স্মারকলিপি দিতে যান জিয়াউর রহমানের আমলে সশস্ত্র বাহিনীতে হত্যা ও নিখোঁজের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’-এর সদস্যরা। এতে পিটার হাস সেখানে তার অবস্থান সংক্ষিপ্ত করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ঘটনার বিবরণ দিয়ে নিরাপত্তার শঙ্কার কথা জানান।

পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে তলব করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। জানানো হয় ঢাকায় পিটার হাসের নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্রদূত ঢাকার অবস্থান ও সেদিনকার ঘটনার ব্যাখ্যা দেন।

এদিকে গত মঙ্গলবার ঢাকার রুশ দূতাবাস তাদের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে জানায়, ‘রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি গ্রহণ করে, সে দেশগুলোর প্রতি রাশিয়া পুরোপুরি সমর্থন জানায়।’

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা যখন সমালোচনা করছেন এবং এর বিরুদ্ধে সরকার কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, ঠিক সে মুহূর্তে রুশ দূতাবাসের বিবৃতি কূটনৈতিক মহলে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

রুশ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘ভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা সম্পর্কিত ১৯৬৫ সালের জাতিসংঘের ঘোষণা অনুসারে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতির বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের নেই। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে হস্তক্ষেপ না করার নীতি লঙ্ঘনের সমস্যাটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ অনেক দেশ বিশ্বাস করে, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে ওই নীতি লঙ্ঘন করতে পারে।

‘নিজেদের উন্নত গণতন্ত্রের অধিকারী বলে দাবি করা দেশগুলোর মধ্যে আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তারা শুধু জাতিসংঘের সার্বভৌম সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপই করে না, বরং নির্লজ্জ প্রতারণা, অবৈধ বিধিনিষেধ আরোপ করে। এতে বিশ্বের অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব খুবই ঝুঁকির মুখে পড়ে। স্বাধীনতা রক্ষা ও ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার বিষয়ে সার্বভৌম দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। যারা নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে, তারা ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ রক্ষার অজুহাতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। এ ধরনের নীতি স্পষ্টতই বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্ব নষ্ট করে এবং বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। এ রকম নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে আছে যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তান।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘তৃতীয় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া তার নীতিগত অবস্থানে সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে স্বাধীন নীতি গ্রহণ করে। রাশিয়া এ দেশগুলোর আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের আরও উন্নয়নের উপায়গুলো নির্ধারণ করতে পারে এবং এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা নব্য ঔপনিবেশিক পদ্ধতির অধীন নয়।’

রুশ দূতাবাসের এ বিবৃতি প্রকাশের পরদিন পাল্টা অবস্থান প্রকাশ করে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। এক টুইট বার্তায় দূতাবাস ইউক্রেন রুশ আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আনে। রাশিয়ার ওই বিবৃতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন শেয়ার করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের টুইট বার্তায় লেখা হয়েছে, ‘ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কি এই নীতি মানা হয়েছে?’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘রাশিয়ান দূতাবাস যে কাজটা করেছে, তা ঠিকই করেছে। এটা ভিয়েনা কনভেনশনের কথা। কেননা একটি দেশ কীভাবে চলবে, তা ওই দেশের নিজস্ব ব্যাপার।

‘এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। আমাদের এই দেশটাকে পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে রেখে গিয়েছিল। সেই ছাইয়ের স্তূপ থেকে আমরা আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। কিছুদিনের মধ্যে আমরা ২১তম অর্থনীতির দেশ হব। তাই আমরা আমাদের রাষ্ট্র চালনার পলিসি ঠিক করব। আমেরিকা বা রাশিয়ার পরামর্শ নিয়ে নয়।’

তবে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারত একটি চুক্তি করেছিল, তারা ভিয়েনা কনভেনশনের বরখেলাপ করবে না। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়া সেই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা বিব্রতকর। কেননা এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত দেশের বিভাজনের রাজনীতিতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছেন।

‘যে ঘটনা ঘটেছে পিটার হাসকে নিয়ে, তাতে বোঝা যায়, এটার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যাওয়া হলো। তবে কেন গেল বা কারা এই বুদ্ধি দিল, সেটা বলা মুশকিল।

‘এ জন্য এমন একটি দিন বেছে নেয়া হলো, ১৪ ডিসেম্বরকে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, যেদিন দেশের শত শত বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ওই দিনে ও রকম একটা বাসায় যাওয়া। অ্যাম্বাসেডর তো তাদের অ্যাম্বাসিতেই ডাকতে পারত, যদি সত্যিই জানতে চাইত। তা না করে বাসায় গিয়ে আলোচনা করা, আবার সে জন্য ওই দিনই বেছে নিল। কেন নিল, তাও বোঝা গেল না। তাতে যা হলো, তা হলো বাংলাদেশের রাজনীতির যে বিভাজন, সেই বিভাজনের মধ্যে পড়ে গেল। তাতে অন্য সংগঠন আছে, যারা মনে করে অন্য যে মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো আছে, যে ব্যাপারে আমেরিকা নিশ্চুপ, তারাও এই সুযোগটা নিল। নাও নিতে পারত। পরের দিন তারা অ্যাম্বাসিতে গিয়ে এটা করতে পারত।

‘এতে বোঝা গেল, পিটার হাস সরাসরি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢোকার একটা চেষ্টা করলেন। এতে বিভাজনের রাজনীতিতে অন্যরাও দেখাতে চাইল যে আমাদেরও বলার কিছু আছে। তাতে গণতন্ত্রের যে মঞ্চ, তার ভিত কতটা মজবুত হলো, বা গণতান্ত্রিক যে চর্চার কথা বলা হয়, তার কতটা লাভ হলো, তা ভাবতে হবে। কেননা এতে তো বিভাজনের যে রাজনীতি তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল।’

তিনি বলেন, ‘এ প্রেক্ষিতেই রাশিয়া তো আর চোখ-কান বন্ধ করে থাকতে পারে না। কেননা এই বিশ্বায়নের যুগে তারাও তো শক্তিশালী প্রার্থী। তারা বলে দিল, এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশন আছে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না, যা পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্র রক্ষার নামে করছে, তা কতখানি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে, কতখানি মানবাধিকারের জন্য করছে বা কতটা তাদের দেশের স্বার্থে, এটা ভাবতে হবে।

‘তারা যদি সত্যিই মানবাধিকার নিয়ে চিন্তা করত, তাহলে তো আফগানিস্তানের ঘটনা ঘটার কথা না। সিরিয়া বা ইয়েমেনে যুদ্ধ হওয়ার কথা না। ফিলিস্তিনে এখনও ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়ার কথা না।

‘রাশিয়া যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য, তাই তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করল। কারণ চুপ থাকলে তো এই মেসেজও যায়, পশ্চিমারা যা করছে, তা হয়তো সঠিক। তারা বলল, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন তো আছে। কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

‘আমরা যেটা চাইব, যারা পশ্চিমা দেশ বা কোনো একটা দেশের প্রতি যে নির্ভরতা, যা বিরোধী দলে থাকলে থাকে, তার সুযোগটাই নিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। কেননা তারা সেখানে গেছে, কারণ কেউ না কেউ তো তাদের বলেছে। আমাদের দেশের রাজনীতির বিভাজন যতদিন থাকবে, ততদিন এসব বিষয় থাকবে। কিন্তু এতে গণতন্ত্রের কী লাভ হবে? এতে বিভাজন তো কমায় না। বরং বাড়িয়ে তোলে।’




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD