কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নালিয়ার দোলাকে নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের টেকনিক্যাল টিম পরিদর্শন ও পর্যালোচনার পর এ সুপারিশ করেছে।
নালিয়ার দোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণের নেপথ্যের কারণ জানতে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, ইউজিসির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারা মনে করছেন, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবসম্মত।
নালিয়ার দোলা
কুড়িগ্রাম শহরের দক্ষিণে সদরের মোঘলবাসা ইউনিয়নের বাঞ্ছারাম মৌজা ও বেলগাছা ইউনিয়নের সড়া মৌজায় নালিয়ার দোলা অবস্থিত। এই স্থানটি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে সরকারের খাসসহ প্রায় ৪০০ একর জমি রয়েছে। এটি এক ফসলি এবং এর পাশ দিয়ে কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেলপথ ও সড়ক পথ গেছে।
ইউজিসির প্রতিবেদন
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনের জন্য ইউজিসি গঠিত তিন সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। একই বছর ২৩ সেপ্টেম্বর কমিটির সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জেলা প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সদর উপজেলার সার্ভেয়ারসহ প্রস্তাবিত স্থানগুলো পরিদর্শন করেন।
পরে কমিটি নালিয়ার দোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সুপারিশ করে জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত স্থানসমূহ সম্পর্কে কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রস্তাবিত তিনটি স্থানের মধ্যে টগরাইহাটের গর্বের দোলা স্থানটির গভীরতা তুলনামূলক বেশি (প্রায় ৮-১২ ফুট)। গভীর ডোবা ভরাট করতে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। স্থানটির দূরত্ব মূল শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে রেলের খাস জমির পরিমাণও বেশি। ফলে অধিগ্রহণে জটিলতা তৈরি হবে।
প্রস্তাবিত দাসেরহাট নামক স্থানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। পক্ষান্তরে নালিয়ার দোলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রাম-চিলমারী মহাসড়কের পাশে। রেল, নৌ ও সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। প্রস্তাবিত এই স্থানটি তুলনামূলক উঁচু ও ফাঁকা জায়গার পরিমাণ আনুমানিক ৪০০ একর। রৌমারী-চিলমারী ও গাইবান্ধা এলাকায় প্রস্তাবিত ও নির্মাণাধীন সেতু স্থাপিত হলে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হবে। নালিয়ার দোলায় ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা সম্প্রসারণ করা যাবে।
যোগাযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা, থানা ও শহর থেকে দূরত্বসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে নালিয়ার দোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করাসহ স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের সুপারিশ করে ইউজিসির কমিটি।
শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নালিয়ার দোলা সবচেয়ে উপযুক্ত উল্লেখ করে ইউজিসির পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘এক ফসলি জমি, সড়ক-রেল ও নৌ যোগাযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা, থানা থেকে দূরত্ব সার্বিক দিক বিবেচনায় নালিয়ার দোলা সবচেয়ে উপযুক্ত। গবেষণার জন্য নালিয়ার দোলা ও এর আশপাশে পর্যাপ্ত উপকরণ রয়েছে। স্থানটি শহরের বাইরে কিন্তু শহর থেকে একেবারেই কাছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, রিসার্স পারসন সবার জন্য সুবিধা হবে। এছাড়া স্থানটি নদীভাঙনমুক্ত। চিলমারীতে তিস্তা নদীর ওপর চিলমারী-হরিপুর (গাইবান্ধা) সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে কয়েক জেলার শিক্ষার্থীদের জন্য যাতায়াত সহজ হবে। এছাড়া রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলা হয়ে জামালপুর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নৌপথে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবেন।’
জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি চাষী এম.এ করিম বলেন, ‘জেলার চরাঞ্চল ও সমতল ভূমিতে গবেষণার পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্পৃক্ততা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নালিয়ার দোলাকে নির্বাচন বাস্তব সম্মত বলে মনে করছি। এই সিদ্ধান্তে আমরা কুড়িগ্রামবাসী অত্যন্ত আনন্দিত।’
নালিয়ার দোলায় দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা উচিত জানিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এস.এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি স্থান নির্বাচনে শুধু আর্থিক ব্যয় বিবেচনা করেন না। তারা মৃত্তিকা, প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, বহুমুখী যোগাযোগ, নাগরিক সুবিধা, প্রণিত বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের নির্দেশনা বা সীমাবদ্ধতা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে স্থান নির্বাচন করেন। সে হিসেবে আমি মনে করি, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ যথোপযুক্ত হয়েছে। এখন বিলম্ব না করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা উচিত।’
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য নালিয়ার দোলা উপযুক্ত উল্লেখ করে কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জেলার মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। এটির অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচন করা হয়েছে; যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি পুরো জনপদের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পত্রের আলোকে নালিয়ার দোলায় জমি অধিগ্রহণের জন্য সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে মতামত চেয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তিনি প্রতিবেদন দিয়েছেন। এখন আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।’