বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৪৩ অপরাহ্ন




অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স: বিশের কম বয়সী রোগীর এক-তৃতীয়াংশের দেহে কাজ করছে না অনেক ওষুধ

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ৭:৩৩ pm
ব্যবসা Model মডেল medical stores store dispensary drugstore ড্রাগস্টোর ডিসপেনসারি ফার্মেসি pharmacy Drug chemical Pharmaceutical medication diagnose cure treat Health Medicine ওষুধ ঔষধ রাসায়নিক চিকিৎসা
file pic

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অযৌক্তিক ও অপপ্রয়োগে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অণুজীব, ভাইরাস, ছত্রাক ও পরজীবীবিরোধী ওষুধগুলো। সহজেই প্রতিষেধককে প্রতিরোধের সক্ষমতা তৈরি করছে নানা জীবাণু। দেশে ২০ বছরের কম বয়সী রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের রেজিস্ট্যান্স বা ওষুধের প্রতি সাড়া না দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে সংক্রমণের চিকিৎসা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। বাড়ছে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি। বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক আকার ধারণ করছে বলে মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশ করে রিসার্চ আর্টিকেল-২০২৩। ওই প্রকাশনায় বেশ কয়েকটি গবেষণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ‘নেশনওয়াইজ জেনোমিক সার্ভে অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস ইন হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটির বাই জেনোম সিকোয়েন্সিং অব রেজিস্ট্যান্স প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া আইসোলেটেড ফ্রম ভ্যারিয়াস ক্লিনিক্যাল স্পেসিম্যানস’ শীর্ষক এক গবেষণায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ভয়াবহতা উঠে এসেছে।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বয়স বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা এমডিআর (বহু ওষুধ প্রতিরোধী) হয়ে উঠেছেন ২০ বছরের কম বয়সী রোগীরা। এ বয়সসীমার ২৯ শতাংশের বেশি রোগীর নমুনায় বহু ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অন্যদের মধ্যে বহু ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বহন করা ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীর বয়স ২০-৪০ বছর, ২৫ শতাংশের বয়স ৪০-৬০ বছর ও ১৮ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে।

গবেষকরা বলছেন, সাধারণত তিনটি জেনেরিকের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সেটিকে বহু ওষুধ প্রতিরোধী বলা হয়। ২০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে এটি বেশি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শিশুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যাদের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে তাদের মধ্যে এমডিআর কম থাকার কারণ হিসেবে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। একটি হলো যেসব ওষুধ শরীরে কাজ করছে না সেগুলো হয়তো তাদের দেয়া হচ্ছে না। অথবা তারা দীর্ঘ সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিকই গ্রহণ করেননি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১২টি বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) সরকারি হাসপাতালের ১৩ হাজারের বেশি রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৪৯টিতে বহু ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া যায়। ওই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত সাত মাস এ গবেষণাটি চালিয়েছে। এতে অর্থায়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং গবেষণার নৈতিকতার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) ইথিক্যাল রিভিউ পর্ষদ।

গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত রোগীরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন। তাদের রক্ত, কফ, পুঁজ, মূত্র, ক্ষত স্থানের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে উঠে এসেছে, বহু ওষুধের প্রতিরোধে জীবাণুর সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রোগীদের মধ্যে। ২১ শতাংশ রোগীদের মধ্যে এমডিআর গড়ে উঠেছে। আর সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের মধ্যে, যা শতকরা ৫ শতাংশ। বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে নেয়া রোগীদের ক্ষতের নমুনার ৯৩ শতাংশে এমডিআর পাওয়া গেছে। আর পুঁজের মধ্যে সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স পাওয়া গেছে শের-ই-বাংলায়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটির ৫৮ শতাংশ পুঁজের নমুনায় এমডিআর পাওয়া গেছে।

গবেষণাটিতে মুখ্য গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার মাইক্রোবায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম। বলেন, ‘এ ধরনের বৃহৎ গবেষণা বাংলাদেশে প্রথম। যেসব জেনোরিকের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তার একটি তালিকাও আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। এতে ৪৩ গোত্র বা জেনোরিকের কথা বলা হয়েছে। রোগীকে কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিলে ব্যাকটেরিয়া তা প্রতিরোধ করে ফেলছে। তবে এ বিষয়ে আরো অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।’

বাংলাদেশে যেসব রোগের জীবাণুতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, যক্ষ্মা, মূত্রনালির সংক্রমণ, নবজাতকের সংক্রমণ, কানের সংক্রমণ, টাইফয়েড জ্বর এবং ত্বক ও নরম টিস্যুর সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য বলে জানান গবেষকরা। দুই বছর আগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট একটি গবেষণায় বলেছে, দেশে ৫২ শতাংশ রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। এতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের হার এ বিভাগে ৮৩ শতাংশ। এরপর খুলনা বিভাগের ৮১ শতাংশ, চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগে ৭৯ শতাংশ করে, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগে ৭৮ শতাংশ করে, রাজশাহী বিভাগে ৭৪ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। সিলেট বিভাগে এ হার সবচেয়ে কম হলেও ৭৩ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রয়েছে। শিশুদের ওপর এর প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক অতিমাত্রায় ব্যবহার ও অপব্যবহারের ফলে এর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। রোগের জীবাণুগুলো হয়ে উঠছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম বড় এ সংকটকে বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করছেন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) হিসেবে। বিশ্বব্যাপী এ সংকট এখন সব দেশেই বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার বৃদ্ধির পেছনেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সেরও দায় রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এটিকে একটি নীরব মহামারী হিসেবে বিবেচনা করছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১৩ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে ব্যাকটেরিয়াল এএমআরের কারণে।

দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, এএমআর দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। আাগামীতে আরো ভয়াবহ হতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর দেখা যাবে বেশির ভাগ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রোগীর শরীরে কাজ করছে না।’

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিষয়ে দেশে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি রয়েছে জানিয়ে এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দেশের সব গবেষণা একত্রিত করে এএমআরের বিরুদ্ধে একটি নীতি তৈরি করা জরুরি। এএমআরের জন্য কী কী কারণ রয়েছে তা আরো সূক্ষ্মভাবে দেখতে হবে।’

গবেষণায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যাপক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ও আক্রমণাত্মক ডিভাইসের কারণে আইসিইউতে ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য এমডিআর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পালমোনারি যক্ষ্মা, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের মতো সহ-অসুস্থতার রোগীরা অন্যদের তুলনায় এমডিআর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের প্রবণতা বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সারা বিশ্বেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বেশির ভাগ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ এখন কাজ করছে না। ওষুধের চেয়ে জীবাণুরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তৃতীয় জেনারেশনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল আবিষ্কারের পর নতুন করে কোনো মৌলিক মলিকুল আবিষ্কার করা যায়নি। দেখা যায়, হাসপাতালে যেসব রোগী সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হন তাদের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের রেজিস্ট্যান্স বেশি।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা যায়নি। দেখা যায়, চিকিৎসক কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিলে মানুষ কোর্স শেষ করেন না। তার আগেই রোগী মনে করেন তার সমস্যার সমাধান হয়েছে, আবার স্বাভাবিক কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও কোর্স শেষ করেন না রোগী। যেসব ওষুধ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ক্রয় করা যায় বা আউট অব কাউন্টার (ওটিসি) ড্রাগ সেগুলোর মতো অ্যান্টিবায়োটিকও বিক্রি করতে দেখা যায়। অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাদের বিপণন নীতিও সঠিক নয়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের রেজিস্ট্যান্স নিয়ে আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। আমরা রেজিস্ট্যান্সের বিষয়ে জনসচেতনা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

সরকারের শীর্ষ এ কর্মকর্তার মতে, ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচের বিষয়ে ভাবতে হবে। মাছে, পানিতে, ফসলে, গাছে, মাংসে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ অ্যান্টিবায়োটিক শেষ পর্যন্ত পানিতে ও মাটিতে গিয়ে পরিবেশ দূষিত করছে। মাটি ও পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু সৃষ্টি হচ্ছে। হাসপাতালগুলোকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রিন্সিপ্যাল মানতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষতে সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগের মৃতদের চেয়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে। [বণিক বার্তা]




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD