রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন




বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার উপর খরচের বোঝা চাপিয়েছে সরকার: সিপিডি

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪ ৪:৩৮ pm
Khondaker Golam Moazzem economist Centre for Policy Dialogue CPD সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
file pic

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের মাসিক খরচ গড়ে ৯.৪ শতাংশ বাড়বে। নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের খরচ বাড়বে ১০৬ থেকে ১১৮ টাকা। অর্থাৎ সরকার বিদ্যুতের বর্ধিত ক্যাপাসিটি না কমিয়ে এ খাতের ভর্তুকির চাপ সম্পূর্ণ ভোক্তার উপর খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, যা অযৌক্তিক।

বুধবার বিদ্যুতের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি; ভর্তুকি সমন্বয়ের অন্য বিকল্প আছে কী? শীর্ষক শিরোনামে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে সিপিডি।

সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সমন্বয়ের নামে দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের নাভিশ্বাস বাড়াবে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বিদ্যুতের বর্ধিত ক্যাপাসিটির খরচ না কমিয়ে ভর্তুকির চাপ ভোক্তার ওপর চাপানো অযৌক্তিক। চাহিদার তুলনায় তিনগুণ হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পেছনে সরকারের ভেতরে-বাইরে যোগসাজশের ইঙ্গিত দিয়েছে সিপিডি।

ইউনিট প্রতি ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ৮.৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়ে ভোক্তার ওপর এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ১৭ শতাংশ বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষকরা বলছে, ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে দর বৃদ্ধির ফলে শিল্পকারখানার খরচের পাশাপাশি ভোক্তাদের খরচ বাড়বে ৯.৪ শতাংশ।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিইআরসি’কে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে সিপিডি। চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকা উৎপাদন সক্ষমতা সমন্বয় না করে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ দেয়ার সমালোচনা করেন তারা।

সিপিডি জানায়, পরিকল্পনামাফিক সরকার আরও দু’বার দাম বৃদ্ধি করলে অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। তাই বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ে বিইআরসির গণশুনানির পদ্ধতি পুনর্বহালের তাগিদ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণে সরকার তার দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়েছে মন্তব্য করে সিপিডি জানায়, গ্যাস থেকে এলএনজি বিদ্যুতে যেতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির কারণ। এই মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার পর বাড়তি চাপ ফেলবে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

নির্বাহী আদেশ নয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে গ্যাস বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সার্থে গণশুনানির মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি বা কমার কাজটি করার দাবি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির। সংস্থাটি বলছে, যে হারে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তা ভোক্তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে। যদিও সরকার বিদ্যুৎ এর দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার ওপর চাপ পড়বে না বলেছে।

এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র নির্বাহী আদেশের ভিত্তিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, এতে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করে সিপিড। অনতিবিলম্বে সরকারকে বিদ্যুৎ জ্বালানি অ্যাক্ট এর ওই ধারা রোহিত করে বিইআরসি এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বিডিং ও গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি। নো ইলেকট্রিসিটি নো পে এর ভিত্তিতে সরকারকে যেতে হবে উল্লেখ করে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সরকারকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়াসহ ৪টি বিকল্প পথরেখাও দিয়েছে সিপিডি ।

কোন প্রেক্ষাপটে সরকার মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিলো সম্মেলনে সে প্রশ্নও রেখেছে সিপিডি। আইএমএফের পরামর্শে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা বলে সরকার যেভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে এটার প্রয়োজনই পড়বে না। সরকার যদি এই ৪ পদক্ষেপ নেয় বিদ্যুৎ খাতে তাহলে ২০২৯ সাল থেকে আর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে না। ক্রমান্বয়ে তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বের হওয়া, বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি বাবদ অর্থ পরিশোধে নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে ব্যবস্থাসহ ৪ বিকল্প পন্থা জানিয়ে সিপিডি বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়ালেই আর ভর্তুকি দিতে হবে না সরকারকে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে যে অব্যাহত ভর্তুকি দিতে হয়, সেই ভর্তুকি সমন্বয়ের অংশ হিসেবেই সরকার এই মূল্যবৃদ্ধি করেছে। সরকার আইএমএফের সঙ্গে যে ঋণ চুক্তি করেছে, সেই চুক্তির একটি শর্ত হলো, জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া, আরেকটি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাবসিডি কমিয়ে আনা। ২০২৬ সালের মধ্যে এই কাজটা করবে বলে সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মূল্য সমন্বয়ের ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের ভোক্তার ওপর, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি অভিঘাত পরিলক্ষিত হয়েছে। আগামী দিনেও এই অভিঘাত পড়বে। আমরা আশ্চর্য হচ্ছি সরকার এটাকে মূল্যবৃদ্ধি বলতে চায় না, সমন্বয় বলতে চায়। আমি জানি না, সমন্বয় আর বৃদ্ধির মধ্যে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য আছে কি না? এটা সরাসরি ভোক্তার ঘাড়ে পড়ছে, যদিও সরকার বলছে তাদের ঘাড়ে তেমন পড়বে না। কিন্তু আমাদের আমাদের বক্তব্য হলো, ভর্তুকি সমন্বয়ের এই উদ্যোগ সরকারের প্রথম প্রাধিকার হতে পারে না। ভর্তুকি সমন্বয়ের জন্য সরকারের প্রথম প্রাধিকার হওয়া উচিৎ হলো, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা বর্ধিত বিদ্যুতের যে ক্যাপাসিটি তৈরি হচ্ছে তার জন্য সরকারকে যে পেমেন্ট দিতে হচ্ছে, সেটিকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়। যদিও সেদিকে সরকার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি গত এক বছর ধরে অব্যহাতভাবে হচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে পাঁচ শতাংশ করে করে প্রতিমাসে বাড়ানো হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে সাড়ে ৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। বলা হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে, আরও দুই ধাপে এই বৃদ্ধি করা হবে। এটা আমাদের জন্য বড় রকম দুশ্চিন্তার কারণ। ভোক্তা পর্যায়ে যখন মূল্যবৃদ্ধির নাভিশ্বাস চলছে, সেই সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নেবার সক্ষমতা ভোক্তার আছে বলে মনে হয় না। এটা ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে আমাদের কাছে মনে হয়।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ভর্তুকি সমন্বয়ের বিকল্প প্রস্তাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার যে মূল্য সমন্বয় করেছে, তাতে সরকারের মাত্র দুই হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি সমন্বয় হবে। এরপরও সরকারকে বিদ্যুতখাতে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা বর্ধিত ভর্তুকি দিতে হবে। সরকার যদি পুরোটাই ভোক্তার ওপরে চাপ দিয়ে করার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে এখনকার সময়ে ১৬.৪০ টাকা আগামী দিনে এটা আরও বেড়ে যাবে। এই চাপ ভোক্তার ওপরে দেওয়ার কথা নয়। যদিও আইএমএফের হিসেবে অনুযায়ী বলা হচ্ছে, এই মূল্য ১২.১১ টাকা, আগামী দুই তিন বছরে এই দাম থাকবে না। এটা বেড়ে হবে ১৬.৪০ টাকা। এই বর্ধিত মূল্যের ত্রুটির দায় যদি ভোক্তার ওপরে চাপানো হয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি আপনারা বুঝতে পারেন। এই জায়গায় সরকারের পরিষ্কার কোনো রোডম্যাপ আমরা দেখছি না। সমন্বয় যদি পুরোটাই ভোক্তাকেন্দ্রিক হয়, তাহলে আমাদের প্রবল আপত্তি থাকবে।

সিপিডি বলেছে, আমরা মূলত চারটি বিকল্প সরকারের কাছে তুলে ধরতে চাই। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চারটি কৌশলের মাধ্যমে সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে পারে, সরকার তার পরিকল্পনা মত যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ফেজ আউট করতে চায়, কুইক রেন্টালগুলোতে ফেজ আউট ঘোষণা হয়েছে, সময়মত সেগুলো থেকে ফেজ আউট করবে। নতুন যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে সেগুলোতে ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে’, পুরনোগুলোর চুক্তি শেষ হওয়ার পরে সেগুলো সব নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে এরমকম ভাড়ায় চুক্তি করবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির খুব কম অংশ ভোক্তার ওপরে দেওয়া যেতে পারে। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফেজ আউট হবে, সরকার বলছে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে যেতে চায়, সে লক্ষ্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতকেন্দ্র দিয়ে রিপ্লেস করতে হবে, যেটা সরকারের পরিকল্পনারই অংশ। এই চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে যদি সরকার তার পরিকল্পনা ঘোষণা করে, তাহলে ২০২৯ সালের ভেতরে সরকারকে আর ভর্তুকি দিতে হবে না।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD